প্রতিক্রিয়া
গ্রামের এক লইত্যা চোরের কাহিনী
আমাদের গ্রামের বাড়ির এক চোরের কথা খুব মনে পড়ছে। লইত্যা চোরা নামে গ্রামে পরিচিত ছিল। তার নাম ছিল আবদুল লতিফ। কিন্তু লতিফ নামে কেউ ডাকেনি, সবাই লইত্যা চোরা বলেই ডাকত।
শাবল আর কোদাল ছিল তার চুরি করার উপকরণ। মাটির পিড়া কেটে রাতের আঁধারে গৃহস্তের ঘরে ঢুকে চুরি করত লইত্যা চোরা। মাঝেমধ্যে ধরা পড়ত। গ্রাম্য সালিশে তার বিচার হতো। উপস্থিত সবার সামনেই তাকে উত্তম-মাধ্যম দেওয়া হতো। দু-চারটা চড়-থাপ্পড়-কিল-ঘুষি, বড়জোর মুরুব্বি কেউ একজন থুতু ছিটাত মাটিতে, সেই থুতু মাটিতে উবু হয়ে নাকের ডগা দিয়ে পরিষ্কার করতে হতো লইত্যা চোরাকে। শাস্তি শেষ। আর কখনো চুরি করবে না, এই বলে কসম-টসম খেয়ে দিব্যি বিদায় নিত।
সালিশ থেকে বের হয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াত। ভাবখানা এমন কিছুই হয়নি। আবার কয়েকদিন পর শোনা যায়, পুবপাড়ার লস্কর বাড়িতে সিঁদ কেটে চুরি হয়েছে। কিংবা পশ্চিমপাড়ার মৃধাবাড়িতে নতুন বউয়ের শাড়ি-গহনা চুরি হয়েছে রাতে, সেই একই কায়দায়, সিঁদ কেটে। আবার বাজারে সবার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় লইত্যা চোরা ধরা। আবার বিচার-সালিশ। আবার স্বীকারোক্তি। আবার সেই শাস্তি। কিন্তু কখনো তাকে পুলিশে দেওয়া হতো না।
এ কারণেই কি না লইত্যা চোরা সেই পথ থেকে কখনো ফেরেনি। চুরিই তার পেশা। কোনো কিছু করত না। দিব্যি সংসার চলে যেত তার। বউ ছিল। মাঝেমধ্যে বউ নিয়ে গ্রামের বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করত। সিনেমা দেখতে যেত অনেক দূরের জেলা সদরের লতা টকিজে। বেশ আরামদায়ক জীবন। নো টেনশন।
এই যে গ্রাম্য সালিশে তাকে উত্তম-মাধ্যমের ব্যাপার, থুতু নাক দিয়ে মোছানো, এগুলো তার কাছে কোনো ব্যাপারই ছিল না। লজ্জা-শরম-সামাজিক অবস্থান, এগুলোকে মনে হয় বুড়িগঙ্গার পানিতে ফেলে দিয়েছিল লইত্যা চোরা। তাই ওগুলোকে নিয়ে তার কোনো চিন্তাটিন্তা ছিল না।
ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি না। সম্প্রতি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে সংবাদপত্রে প্রতিবেদন পড়ে কেন যেন সেই লইত্যা চোরার কথা খুব মনে পড়ছে। তাই এ লেখার চেষ্টা।
গত পাঁচ-ছয় বছরে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি হয়েছে, তার কথা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি অনেকে। আবার কেউ কেউ ব্যাংকের বড় বড় কর্মকর্তা হয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে স্বনামে-বেনামে। ধরা পড়েছে, জেলে গিয়েছে। আবার জামিনে ছাড়া পেয়েছে। পত্রিকায় বড় গলায় কথা বলেছে। আবার কেউ বা জেলে গিয়ে অসুস্থতার ভান করে বড় বড় হাসপাতালে সেবা নিচ্ছে মাসের পর মাস।
পত্রিকায় কারো কারো ছবি ছাপা হচ্ছে, ছাপা হচ্ছে কার্টুন। তারপরও লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে দিব্যি কথা বলে যাচ্ছে সবার সামনে। আবার কাউকে কাউকে বিদেশে চলে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। কী চমৎকার তামাশা!
সেই তামাশার মূল আয়োজক কারা? তাদের নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না। কারা সুযোগ করে দিচ্ছে কোটি কোটি টাকা লোপাট করার? কারা জনগণের টাকা থেকে কর কেটে নিয়ে ব্যাংক খাতকে বাঁচিয়ে রেখে আবার লোপাট করার সুযোগ করে দিচ্ছে? সেই প্রসঙ্গে গেলেই গণেশ অখুশি। মুখ গোমরা করে রাখে।
সেই প্রসঙ্গে না গিয়ে সেই লইত্যা চোরার কথাই আসি আবার। আমাদের ব্যাংক খাতকে কারা চুরি করে শেষ করে দিচ্ছে? তাদের কি ওই লইত্যা চোরার মতো অবস্থা হয়ে গেছে? কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সামাজিকতার। পত্রপত্রিকায় নাম ছাপা হচ্ছে চুরির দায়ে। অবৈধ কাজে সহযোগিতা করায় সমালোচনা হচ্ছে এখানে সেখানে। কিন্তু তারা তাদের মতোই আছে, বহাল তবিয়তে।
এর প্রধান কারণ কী? দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নেই। একজন চোরেরও লইত্যা চোরার মতো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। তাই তো লইত্যা চোরার মতো ঘুরে বেড়ায় জমিদারি স্টাইলে। দেশে সব ধরনের আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। আইন আছে শুধু গরিবের জন্য। নিম্নবিত্তের জন্য। বড়লোকদের জন্য আছে ভোগবিলাস। জেলখানায় গিয়েও তারা থাকে রাজার হালে। সেই জন্য চুরিতে উৎসাহ বেড়েছে। ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। কারণ জানে, কোনো না কোনো উপায়ে বের হতে পারবেই। আর যদি রাজনৈতিক সাইনবোর্ডটা থাকে। বংশে কোনো প্রভাবশালী নেতা-উপনেতা থাকে, তা হলে তো কোনো কথাই নেই।
সেই লইত্যা চোরার কথা খুব মনে পড়ছে। নাক দিয়ে থুতু তুলে নিত। কোনো লজ্জা নেই। আর ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ফেরত না দিয়ে সেই লইত্যা চোরার মতোই ঘুরে বেড়ায় কত লইত্যা চোরা এ সমাজে। থুতু নাক দিয়ে তুলে নিয়েও এদের কোনো লজ্জা নেই। কারণ এরা জানে এদের কিছুই হবে না। যেমনটা জানত লইত্যা চোরা।
লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক।