এক্সট্রা কাভার
ভারতে অলরাউন্ডার জরিপ ও আমাদের সাকিব
ক্রিকেট ইতিহাসে তাঁর জন্য বড় একটা জায়গা বরাদ্দ থাকবে। তবে খুব ছোট করে বললে বলতে হবে; স্যার গারফিল্ড সোবার্স সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে অলরাউন্ডার হিসেবে তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। আগে যাঁরা ছিলেন তাঁরা তাঁর কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেন। কিন্তু তাঁকে অতিক্রম করে যেতে পারেননি। সোবার্স-পরবর্তী জমানায়ও কেউ তাঁকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি। তবে সোবার্স-পরবর্তী সময়ে খুব জোরালোভাবে একটা প্রশ্ন উঠেছে; ইমরান-বোথাম-কপিল-হ্যাডলি কি সেরা অলরাউন্ডার? কারণ, ক্রিকেট নামক খেলাটা একসঙ্গে এ রকম প্রভাবশালী চারজন অলরাউন্ডার আর পায়নি। মেধা-যোগ্যতা-দক্ষতা-ব্যক্তিত্ব দিয়ে এঁরা অসামান্য প্রভাব রেখে গেছেন ক্রিকেটে। চারজনই ছিলেন মূলত ফাস্ট বোলার। কিন্তু যে কোনো দলে জায়গা পেতে পারতেন শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে। টেস্ট বলুন কিংবা ওয়ানডে বলুন, দারুণ সব ইনিংস রয়েছে এঁদের প্রত্যেকেরই। ক্রিকেট নিয়ে যাঁরা নস্টালজিয়ায় ভোগেন, এখনো তাঁদের কাছে অলরাউন্ডার বলতে সোবার্স-পরবর্তী সময়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওই চার মূর্তি!
হ্যাঁ, ওঁদের সময়ের আরেকজন ভাগ্যবিড়ম্বিত অলরাউন্ডার ছিলেন। সাউথ আফ্রিকার ক্লাইভ রাইস। নিজের দেশের বর্ণবৈষম্যনীতির কারণে যাঁর টেস্ট খেলাই হলো না। না হলে হয়তো ওই চারজনের সঙ্গে রাইসের নামটাও ঢুকে পড়ত। কাউন্টি ক্রিকেট আর তাঁর ফাস্ট ক্লাস ক্যারিয়ার সে দাবিই করে। বোথাম-ইমরান-কপিল, হ্যাডলি-পরবর্তী সময়েও ক্রিকেট বিশ্ব জ্যাক কালিস-শন পোলক-ওয়াসিম আকরাম-অ্যান্ড্রু ফ্লিন্টপের মতো অলরাউন্ডার দেখেছে। তবে বোথাম-কপিল-ইমরান-হ্যাডলিকে অন্য সরণিতে রাখতে হবে। অলরাউন্ডার হিসেবে ক্রিকেট গ্রহে তাঁরা সত্যিই অন্য সরণির বাসিন্দা।
এখন প্রশ্ন যদি করেন ওই চার ক্রিকেটারের মধ্যে কে সেরা? এটি আসলে প্রশ্ন নয়, বিতর্ক এবং এই বিতর্ক ছিল চলমান তাঁদের ক্যারিয়ারজুড়ে। এমনকি তাঁদের অবসরত্তোর জীবনেও তর্কটা মিলিয়ে গেছে তা নয়। ক্রিকেট বিশ্লেষক, ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা যে যাঁর মতো করেই উত্তর দিয়েছেন। এখনো দিচ্ছেন। আর এই প্রশ্ন ক্রিকেট ছেড়ে আসার এত বছর পরও কপিল-ইমরান-বোথাম-হ্যাডলিকে বহুবার বহুভাবে শুনতে হচ্ছে। উত্তর দিতে হচ্ছে। উত্তরটা যে যার মতো করেই দিচ্ছেন। তবে তার মধ্যেও একটা জিনিস খুঁজে পাওয়া যায়। প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু তাঁদের মধ্যে পেশাদারি শ্রদ্ধাবোধের ঘাটতি নেই।
কে সেরা, সেটা বিচার করতে গেলে এখন হয়তো তাঁদের পরিসংখ্যান নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে। কিন্তু পরিসংখ্যান দিয়ে এসব গ্রেটদের গ্রেটনেস মাপা যায় না। মাপা ঠিকও হবে না। আবার তাঁদের সময়ে আইসিসি নামক ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো রেটিং কিংবা র্যাংকিং-ট্যাংকিং চালু হয়নি। তাই খুব সহজে বলে ফেলা যায় না অমুক সেরা! তা ছাড়া প্রত্যেকের ক্যারিয়ারের ওঠা-নামার গ্রাফ আছে। তাঁরা নিজেরাও সেটা স্বীকার করেছেন। তাই ক্যারিয়ারজুড়ে বিচার করা সত্যিই কঠিন। ইমরান যেমন ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসে বলেছিলেন, ‘স্বীকার করতে আপত্তি নেই, আমার বোলিং আগের মতো ধারালো নেই। এখন তাই অনেক কিছু নির্ভর করে আমার ব্যাটিংয়ের ওপর।’ সত্যিই শেষ দিকে ইমরান খেলেছেন দলে মূলত একজন স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে। যিনি মাঝেমধ্যে পেস বলটা করতেন। তবে ইমরান বিশ্বাস করেন, ক্রিকেটের সেরা আকর্ষণ হচ্ছে ফাস্ট বোলিং। অনেক দিন আগে তাই প্রশ্নটা করেছিলেন, ‘ডেল স্টেইন ছাড়া এখন একজনও ফাস্ট বোলার আছেন? আমাদের সময় যে কোনো দলে ও রকম দু-তিনজন স্টেইন থাকত।’ বর্তমান ক্রিকেটারদের সম্পর্কে যাই বের হয়ে আসুক না কেন, প্রতিদ্বন্দ্বীদের সম্পর্কে এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ কিন্তু বেরিয়ে এসেছে ইমরানের প্রশ্নে।
চার অলরাউন্ডার প্রশ্নে রিচার্ড হ্যাডলি যেমন বলেছিলেন, ‘রেটিংটা এক-একটা সিরিজ অনুযায়ী হয়। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের সময় লড়াইটা ছিল কপিল আর ইমরানের মধ্যে। একইভাবে ইংল্যান্ড নিজজিল্যান্ড ম্যাচে অবশ্যই বোথাম আর আমার মধ্যে। পুরো ব্যাপারটা ফর্মের ওপর নির্ভর করত। তবে ক্লাইভ রাইস যেহেতু টেস্টে ছিলেন না, তাই ও তুলনায় আসেনি। কিন্তু টেকনিক্যাল দিক থেকে বিচার করা হলে রাইস-ই সেরা।’
বোথামের মন্তব্যে অনেক বেশি কূটনীতির সুর জড়ানো। ‘এমন কোনো জায়গায় নাক গলানোর দরকার নেই যেখানে তুমি সেকেন্ড হতে পারো।’ বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় অলরাউন্ডারদের তালিকায় বোথাম নিজেকে কোথায় রাখেন।
বাকি রইলেন কপিল দেব। তুলনা-টুলনায় যেতে খুব বেশি পছন্দ না তাঁর। কিন্তু তিনি কত বড় বড় মাপের ক্রিকেটার ছিলেন সেটা স্পষ্ট ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা দুই অধিনায়কের আক্ষেপের মধ্যে। মনসুর আলী খান পতৌদি একবার বলেছিলেন, ‘আমার দলে যদি একজন কপিলকে পেতাম তাহলে অধিনায়ক হিসেবে আমার পরিসংখ্যানটা অন্যরকম হতো।’ আর সাম্প্রতিক সময়ে সৌরভ বলেছেন, ‘আমার যদি একজন কপিল থাকত, তাহলে বিশ্বকাপ ফাইনাল না জেতার আক্ষেপ নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করতে হতো না!’ ইমরান-কপিল দুজনই বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে চ্যাম্পিয়ন করেছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। অন্যদের থেকে এই জায়গাটায়ও আলাদা হয়ে যান তাঁরা। তারপরও সেরা অলরাউন্ডারের বিতর্ক তাঁদের তাড়িয়ে বেড়াবে যদি তাঁদের থেকে আরো বড় মাপের অলরাউন্ডার না পায় ক্রিকেট বিশ্ব।
তবে দিনকয়েক আগে কলম্বোর পি সারা ওভালে ভারত-শ্রীলঙ্কা দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় দিন বর্তমান সময়ে সেরা টেস্ট অলরাউন্ডার বেছেন নিতে হঠাৎ করে একটা জনজরিপের উদ্যেগ নিল সনি টেলিভিশন! সনি স্পোর্টসের ফেসবুক পেজে ভোটের মাধ্যমে সেরা টেস্ট অলরাউন্ডার নির্বাচনের চেষ্টা হলো! নমিনেশন তালিকায় থাকল গোটা চারেক নাম। বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান, যিনি শুধু টেস্ট নয়, আইসিসির ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি তিন ফরম্যাটেই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। তারপর ছিলেন ভারতের রবি চন্দন অশ্বিন। যিনি মূলত একজন অফ স্পিনার। সঙ্গে শ্রীলঙ্কার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ আর ইংল্যান্ডের মইন আলী। হঠাৎ করে কেন এই জনজরিপ? তাহলে কি আইসিসি র্যাংকিং নিয়ে সন্দেহ আছে ভারতীয় টেলিভিশন কোম্পানির? নাকি সাকিব আল হাসান কীভাবে এক নম্বর অলরাউন্ডার হয়ে যাচ্ছেন সেই প্রশ্নটা তাদের মনে খোঁচা দিচ্ছে! যে কারণে এই জনজরিপ কিংবা জনভোট? যদি ভারতীয়দের ভালোবাসার ভোটে রবি চন্দন অশ্বিনের মতো কোনো একজন অফ স্পিনার সেরা টেস্ট অলরাউন্ডার হয়ে যান! কিন্তু দুর্ভাগ্য অশ্বিন আর ভারতীয়দের। সেই ভোটের ফলাফলটাও সাকিবের পক্ষেই গেছে। শতকরা ৪৬ ভাগ ভোট পেয়েছেন বাংলাদেশের এই অলরাউন্ডার। তবে এটা ঠিক আইসিসির রেটিং আর র্যাংকিং নিয়ে প্রশ্ন জাগতেই পারে মানুষের মনে। আইসিসির শীর্ষ টেস্ট অলরাউন্ডারদের তালিকায় রবি চন্দন অশ্বিন কীভাবে দ্বিতীয় স্থানে থাকেন? ২০১৩ সালের পর থেকে ১৮ ইনিংসে যার একটা মাত্র হাফ সেঞ্চুরি! অলরাউন্ডারের সংজ্ঞাটা বোধহয় দিনে দিনে পাল্টে যাচ্ছে। স্যার গারফিল্ড সোবার্স, স্যার ইয়ান বোথাম, স্যার রিচার্ড হ্যাডলি, মিস্টার ইমরান খান, মিস্টার কপিল দেব, আপনার দুঃখ পাবে না এই তালিকা দেখে। এখন নতুন যুগ। নতুন সব প্লেয়ার। আর তাদের সময়। আপনাদের সময় চলে গেছে। আপনার তো এখন ‘ওয়াটার আন্ডার দ্য ব্রিজ।’
লেখক : সাংবাদিক