বিশ্ব সুখ দিবস
ফিলিং হ্যাপি?
জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশন নেটওয়ার্ক সম্প্রতি যে ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ ফিনল্যান্ড। আর সবচেয়ে কম সুখী আফ্রিকার দেশ বুরুন্ডি।
গত বছর এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১০। কিন্তু এবার সেটি পাঁচ ধাপ নিচে নেমেছে। এবার বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫। তার মানে কি এই যে, বাংলাদেশের মানুষের অসুখী হবার মতো ঘটনা বাড়ছে বা বাংলাদেশের মানুষের সুখানুভূতি হ্রাস পাচ্ছে? ২০১২ সাল থেকে জাতিসংঘ এ তালিকা তৈরি করে আসছে। ছয় বছর ধরে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৮ থেকে ১১০-এর মধ্যে ছিল। কিন্তু এবার পাঁচ ধাপ পিছিয়েছে।
জাতিসংঘ মনে করে, ‘যেসব দেশে সমৃদ্ধির মধ্যে ভারসাম্য আছে, অর্থাৎ যেসব দেশে সমাজের চূড়ান্ত পর্যায়ের আস্থা আছে, অসমতা কম ও সরকারের প্রতি জনগণের পূর্ণ আস্থা আছে—সেসব দেশ সাধারণ মাপকাঠিতে সুখী দেশ।’ বিশ্বের সুখী দেশের এই তালিকাটি তৈরি করতে ছয়টি মানদণ্ডকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এগুলো হচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদন, স্বাস্থ্যকর জীবনের প্রত্যাশা, স্বাধীনতা, উদারতা, সামাজিক সমর্থন ও দুর্নীতিমুক্ত সরকার ও ব্যবসা।
দেখা যায়, সবচেয়ে সুখী দেশের তালিতায় বরাবরই ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্কের মতো দেশগুলোর নাম উঠে আসে। পক্ষান্তরে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থাকে তালিকার সবচেয়ে নিচে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে অস্থির ও অস্থিতিশীল দেশগুলো। বাংলাদেশও কম সুখী দেশের তালিকায় থাকে। যদিও সব সময় এটি বলতে শোনা যায় যে, বাংলাদেশের মানুষ খুবই সুখী। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভুটান সবচেয়ে স্থিতিশীল এবং সম্ভবত এ কারণেই সেখানকার মানুষ এই অঞ্চলের যেকোনো দেশের তুলনায় অধিকতর সুখী। শুধু তাই নয়, ভুটান সরকার মোট জাতীয় সুখ বৃদ্ধিকে তাদের জাতীয় লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে।
জাতিসংঘের এই ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট প্রকাশের কিছুদিন আগেই ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির যে ধারণাসূচক প্রকাশ করে, সেখানে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ দুর্নীতি কিছুটা কমেছে। অথচ ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট বলছে বাংলাদেশের মানুষের সুখানুভূতি কমেছে। অথচ দুর্নীতি কমলে সুখের গড় বৃদ্ধি পাওয়ার কথা।তার মানে সুখ কেবল দুর্নীতি কমাবৃদ্ধির সঙ্গেই সম্পর্কিত নয়। দুর্নীতি একটি রাষ্ট্রের সামগ্রিক সমস্যা এবং এটি সরাসরি সে দেশের অর্থনীতি, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ইত্যাদির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পক্ষান্তরে সুখ একটি মানবিক অনুভূতি। একজন দুর্নীতিমুক্ত আপাদমস্তক ভালো মানুষও ব্যক্তিজীবনে অসুখী হতে পারে। আবার বহু দুর্নীতিবাজ মানুষই ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে সুখী।
গ্রামের একজন দিনমজুরও দেশের সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তির চেয়ে অধিকতর সুখী হতে পারে। আবার অতি সম্পদশালী এবং বাইরে থেকে একজন মানুষকে যথেষ্ট সুখী বলে মেনে হলেও, তার পরিবারে কিংবা তার ব্যক্তিজীবনে এমন কোনো ক্ষুদ্র বিষয়ও থাকতে পারে, যা তাকে প্রতিনিয়ত কাঁদায়, ভোগায়। তাকে সুখী হওয়ার পথে বিরাট অন্তরায় তৈরি করে। কেউ আবার সুখ-সাচ্ছন্দ্যের সব আয়োজনের ভেতরেও অসুখী হতে পারেন। জীবনানন্দ এই অবস্থাকে বলেছেন ‘বিপন্ন বিস্ময়’। ব্যাখ্যাতীত এই অবস্থায় একজন দারুণ সুখী মানুষও গলায় একগোছা দড়ি পেঁচিয়ে ঝুলে পড়তে পারেন অশ্বত্থের ডালে। ফলে সুখের সর্বজনীন কোনো সংজ্ঞা বা কোনো পরিস্থিতিতে মানুষ সুখী হবে, সে বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ নেই।
প্রতিটি মানুষের সুখী হওয়ার তরিকা ভিন্ন। তবে আমরা যখন কোনো একটি রাষ্ট্রের মানুষর সামগ্রিক সুখের গড় বা হ্যাপিনেসের জেনারেল ট্রেন্ড নিয়ে কথা বলি, তখন সেখানে সেই দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মানুষের সহনশীলতা, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ও বিশ্বাস কেমন––সেই বীজগণিতও বিবেচনায় রাখতে হয়। কেননা একজন ব্যক্তির সুখী হওয়ার পেছনে তার পারিপার্শ্বিকতা বিরাট ভূমিকা পালন করে।
অনেক সময় সুখের পেছনে ছুটতে গিয়ে ব্যর্থতাও অসুখের জন্ম দেয়। যে কারণে কোনো কোনো পণ্ডিত সুখের পেছনে অধিককতর ছোটাছুটিকে হানিকর বলে মনে করেন। কেউ কেউ সুখকে প্রজাপতির সঙ্গে তুলনা করে বলেন, সুখ হচ্ছে প্রজাপতির মতো যাকে তাড়া করে ধরা যায় না। বরং নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকলে সে নিজেই আপনার গায়ে এসে বসবে।
বাংলাদেশের মানুষ অল্পতে সুখী হয়––এটি যেমন মুদ্রার একপিঠ, তেমনি বাংলাদেশেরই অজস্র মানুষ বিশেষ করে যারা সম্পদশালী তারা নিজেদের সম্পদ আরো বাড়ানোর জন্য যেরকম প্রাণপাত করে তাতে মৃত্যুর আগে তারা আর সুখের দেখা পায় না। আবার কারো কারো কাছে হয়তো এই সম্পদ ও ক্ষমতার পেছনে আমৃত্যু ছুটে চলাই একধরনের সুখ। ফলে সুখ কার কাছে কোন প্রক্রিয়ায় ধরা দেবে, কে কোন উপায়ে সুখ উদযাপন করবে বা কার কাছে সুখের ব্যাখ্যা কী––সেটি নির্ভর করে তার নিজের বোধ, চিন্তা-চেতনা ও দর্শনের ওপর।
গত ৯ ফেব্রুয়রি ‘সুখী হওয়ার পাঁচটি উপায় : অধ্যাপকের পরামর্শ’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে বিবিসি, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান এবং কগনিটিভ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক লরি স্যান্টোসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘বিজ্ঞানে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে সুখী হতে হলে সচেতন প্রচেষ্টার প্রয়োজন।’
তাঁর মতে, ‘সুখী হওয়ার বিষয়টি এমন নয় যে এটা আপনা-আপনি হয়ে যায়। সুখী হওয়ার জন্য আপনাকে এটা চর্চা করতে হবে।’ কিভাবে সুখী হতে হবে তার কিছু কলাকৌশল তিনি শিক্ষার্থীদের শেখান সপ্তাহে দুদিন। সুখী হতে তিনি কিছু উপায়ও বাতলে দেন; যেমন-নিশ্চিন্তে ঘুমানোর চেষ্টা করা; প্রতি রাতে আট ঘণ্টা করে ঘুমানো; প্রত্যেকদিন ১০ মিনিট করে মেডিটেশন বা ধ্যান করা; পরিবার ও বন্ধুদের সাথে আরো সময় কাটানো’ সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগের পরিবর্তে বাস্তবে মানুষের সাথে যোগাযোগ বাড়ানো। অধ্যাপক স্যান্টোস মনে করেন, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সুখের বিষয়ে মিথ্যা যেসব ধারণা পাওয়া যায় সেসবে ভেসে যাওয়া উচিত নয়।
এর প্রায় ছয় মাস আগে ২০১৭ সালের ২৩ আগস্ট বিবিসির আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু হাসিখুশি থাকলেই মানুষ সুখী হয় না। অনেক সময় রাগ এবং ঘৃণা প্রকাশ করেও মানুষ সুখী হতে পারে। একটি নতুন গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মানুষ যখন তার আবেগ ও ইচ্ছে প্রকাশ করতে পারে তখনই মানুষ সুখী হয়। এ আবেগ কিংবা অনুভূতি সবসময় সুখকর নাও হতে পারে। এই গবেষণার দলনেতা এবং জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মায়া তামির বলেন, ‘আপনার মনে যদি কোনো অনুভূতি জমা হয়, তাহলে সেটি প্রকাশ করে ফেলাই ভালো। সেটা সুখকর অনুভূতি নাও হতে পারে।’ গবেষকরা দেখেছেন, নেতিবাচকভাবে মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমেও অনেকে সুখী হয়। এ ক্ষেত্রে রাগ ও ঘৃণা প্রকাশের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি উঠে এসেছে।
ফেসবুকে বিভিন্ন আনন্দময় ঘটনার বিবরণ কিংবা ছবি দিয়ে সেখানে আমরা প্রায়ই ‘ফিলিং হ্যাপি’-জাতীয় ট্যাগ দেই। অর্থাৎ সুখ একটি মানবিক অনুভূতি। সুখ কখনো একটি পারসেপশন বা ধারণা; কখনো আপেক্ষিক অবস্থা। ফলে এই মুহূর্তে যিনি ‘ফিলিং হ্যাপি’ ট্যাগ দিলেন, খানিক বাদেই অন্য কোনো একটি সংবাদে কিংবা ঘটনায় তিনি একেবারেই উল্টো ট্যাগও দিতে পারেন। তিনি হয়তো লিখলেন ফিলিং অ্যাংরি বা ফিলিং সরো।…
অর্থাৎ মানুষের এই আনন্দিত হওয়া বা দুঃখিত হওয়া প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল। ফেসবুকে অনেকে ‘আমি একজন সুখী মানুষ’––এ রকম স্ট্যাটাসও দেন। তার মানে কি ওই ব্যক্তি সদাই সুখী? একজন মানুষের পক্ষে প্রতিনিয়ত সুখী থাকার সুযোগ নেই। বরং সুখী থাকার চেষ্টা থাকতে পারে। সুখী থাকার ভানও করা যেতে পারে। আবার একজন মানুষ সব সময়ই অসুখে বা নিরানন্দেও থাকেন না। খুব জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত একজন মানুষও বিছানায় শুয়ে যদি কোনো একটি ভালো সংবাদ শোনেন, তিনিও মুচকি হেসে ওঠেন। তার মানে চরম অসুখে থাকা মানুষও সব সময় অসুখী নন।বিজ্ঞানীরা বলেন, ব্যক্তির সুখের ওপর মানুষের কোনো হাত নেই। বরং সুখ হচ্ছে একটি জৈবচেতনা যা সৃষ্টি হয় মানুষের মস্তিষ্কে।
‘আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি’ গ্রন্থে ড. আকবর আলি খানের দেওয়া সুখসম্পর্কিত কয়েকটি তথ্য দিয়ে লেখাটা শেষ করা যাক। ব্রুনো এস ফ্রে এবং অলিয়েস স্ট্রটজারের (২০০২)উদ্ধৃতি দিয়ে মি. খান লিখেছেন :
১. নারীরা পুরুণের চেয়ে অধিকতর সুখী।
২. সবচেয়ে অসুখী হলো ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়স্ক লোকেরা।
৩. পুরুষরা যে ধরনের মানসিক আঘাত সহ্য করতে পারে মেয়েরা তা পারে না।
৪. বিয়ে সুখের কারণ নয়, বরং সুখী মানুষেরাই বিয়ে করে থাকে।
লেখক : সংবাদিক