নারী দিবস
ধর্ষণ রোধে আইন থাকাই কি যথেষ্ট?
আজকের এই সভ্যতার অগ্রযাত্রা তো কেবল পুরুষের একক কর্মের ফল নয়। কবির ভাষায়: “বিশ্বের যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যাণকর। অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।” কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, নারী আজও সমাজে অনগ্রসরমান। তা ছাড়া নারীর শক্তিকে দমিয়ে রাখার প্রয়াস তো আছেই। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে সাম্যবাদী নারীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণার প্রস্তাব করেন জার্মান কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিন। ১৯৭৪ সালে দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। এরপর থেকে দিনটি পালিত হয়ে আসছে বিশ্বজুড়ে। নারী দিবসে প্রতিবারই আসে নারীর প্রতি বৈষম্য, সহিংসতা, নিপীড়ন রোধ করার আহ্বান। তারপরেও বন্ধ নেই এই সামাজিক অসুখ। সেই অসুখের এক বিষফোঁড়ার নাম ধর্ষণ। কেন এই ধর্ষণ? কী কী ফ্যাক্টর কাজ করে এর পেছনে? সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে আলোচনা করা হয়েছে বিষয়টিকে। ধর্ষণের কারণ সন্ধানে এবং তার নির্মূলে কী করণীয়- তাই এ লেখার সারবস্তু। চলুন, মূল আলোচনায় আসা যাক।
জঙ্গলে বাস করতে হলে পশুদেরও নাকি কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। কিন্তু তথাকথিত সভ্য সমাজেও মানুষ মাঝে মাঝে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কাই করে না। কোনো কোনো সময়ে মানুষ হয়ে ওঠে পশুর চেয়েও ভয়ঙ্কর। ভাবতে খুব অবাক লাগে, পাশের বাড়ির পরিচিত চাচাও দাঁত-নখ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছোট্ট শিশুর ওপর। কোনো একসময় আবার অতি ভরসার বন্ধুও হয়ে ওঠে হিংস্র হায়েনা। কেন হয় এ রকম? তবে কি যেকোনো মানুষের মধ্যেই থাকে ধর্ষণ-প্রবৃত্তি?
ধর্ষণ মারাত্মক অপরাধ জেনেও মনে চেপে বসে এই কুৎসিত প্রবৃত্তি। ন্যায়-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা, শাস্তির ভয় সবকিছুকে উপেক্ষা করে মাথা তুলে দাঁড়ায় এই ঘৃণ্য আকাঙ্ক্ষা। নিঃসন্দেহে এটি মানসিক বিকৃতির প্রকাশ। যদিও এই বিকৃতির ধরনটা একেক ক্ষেত্রে একেক রকম। নিকোলাস গ্রথ তাঁর ‘মেন হু রেপ : দ্য সাইকোলজি অব দি অফেন্ডার’ বইয়ে প্রকৃতি অনুযায়ী ধর্ষকদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। বইটি একটু সংক্ষেপে তুলে ধরা যাক :
অ্যাঙ্গার রেপিস্ট : এই ধরনের ধর্ষণ ঘটে থাকে অপর পক্ষের ওপর জমে থাকা রাগ বা প্রতিহিংসা থেকে। ধর্ষণই তাদের কাছে রাগের চরম বহিঃপ্রকাশ।
পাওয়ার রেপিস্ট : নারীর ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করার বাসনা, শক্তি ও ক্ষমতা প্রদর্শনের ইচ্ছে থেকেই এমন প্রবৃত্তি জমে পুরুষের মনে। নারীকে নিজের বশে আনা ও নিজের ক্ষমতা বুঝিয়ে দেওয়াই এই ক্ষেত্রে ধর্ষকের প্রকৃত উদ্দেশ্য।
স্যাডিস্ট রেপিস্ট : নারীকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে পাশবিক আনন্দ পাওয়াই এই ধর্ষণকারীদের স্বভাব। এরা অনেক সময় নিয়ে নানাভাবে অত্যাচার করে, নারীকে আঘাত করে তৃপ্তি পায়। শেষ পর্যন্ত নারীটির মৃত্যুও ঘটে কিংবা ধর্ষক নিজেই তাকে খুন করে বিকৃত যৌন আনন্দ ভোগ করে।
এখন দেখা যাক, কেন ঘটছে এত ধর্ষণের মতো ঘটনা। সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে কাজ করে বেশ কয়েকটি কারণ। সেই কারণগুলোই চিহ্নিত করা যাক এবার :
পারিবারিক কারণ : পরিবারে যদি নারীদের অসম্মান করা হয় কিংবা বাবাকে যদি দেখা যায় প্রতিনিয়ত মায়ের সঙ্গে অশোভন আচরণ করতে, তাহলে এমন ব্যবহার দেখে বড় হয়ে ওঠা ছেলেদেরও নারীর সম্পর্কে নেতিবাচক মানসিকতা তৈরি হতে থাকে। ভবিষ্যতে যার ফলাফল ভয়াবহ হয়।
সামাজিক কারণ : কন্যা সন্তানকে অবহেলা করা কিংবা কন্যা ভ্রুণ নষ্ট করা সমাজে বড় হয়ে ওঠা ছেলেদের মনেও নারীদের প্রতি অসম্মান তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সমাজে এমন জেন্ডার বৈসম্য খারাপ প্রভাব ফেলে অনায়াসেই।
পারিবারিক ভাঙন : বিবাহবিচ্ছেদের ফলে সন্তানটি যদি ছোটবেলা থেকেই বাবার কাছে মানুষ হতে থাকে, আর মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়, তবে সেই ছেলের মনে নারীর সম্পর্কে খারাপ ধারণা তৈরি হওয়ার সুযোগ থেকে যায়।
বন্ধুত্বপূর্ণ মেলামেশার অভাব : সমাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছোটবেলা থেকে ছেলে ও মেয়ের মধ্যে সহজ বন্ধুত্ব গড়ে তোলায় বাধা দেওয়া হয়। তাই ছেলেদের ভেতর ছোটকাল থেকেই নারীর সম্পর্কে অনেক কৌতূহলের জন্ম নেয়। নারীদেহকে সেক্সচুয়াল অবজেক্ট ভাবতে শুরু করে অনেকেই।
বিকৃত বিনোদন : নাটক, সিনেমা এবং অন্য কিছু টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে উসকানিমূলক গান, নাচ বা কিছু দৃশ্য দেখে নারীদের কেবলই ভোগের বস্তু বলে মনে করে কিছু পুরুষ। সেই মনোভাব থেকেই জন্ম নেয় এক উদগ্র বাসনা। তাই সুযোগ পেলেই নারী দেহের ওপর হামলে পড়ে তারা।
বিচারের অভাব : ক্ষমতাশালী, উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আসা ছেলেরা এসব অপরাধ ঘটিয়ে প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখায় ক্ষমতার জোরে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ এফআইআর নিতে চায় না। ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে গিয়েও হেনস্থা হতে হয় ধর্ষণের শিকার নারীদের। তা ছাড়া সমাজের কটূক্তি, ধর্ষিত নারীর চরিত্র নিয়ে কাটাছেড়া তো আছেই। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটনা আইনি পথে এগুনোর আগেই হারিয়ে যায় অতল গহ্বরে।
কথা হলো, ধর্ষণ আগেও ঘটেছে, তবে এখনকার মতো এত প্রকাশ্যে আসত না। এটাও ঠিক যে গত তিন-চার দশকে ক্রমশ বেড়েছে ধর্ষণের সংখ্যা। এর পেছনেও রয়েছে কিছু আর্থ-সামাজিক কারণ। আমাদের সমাজে নারীদের সম্পর্কে কিছু অমূলক ধারণা শিকড়ের মতো গেড়ে বসেছে। সামাজিকভাবে নারীদের দেওয়া হয় না অধিকারের মর্যাদাও। কর্মক্ষেত্রেও অনেকসময় নিরাপত্তা অভাব দেখা যায়। এই অবস্থা পাল্টাতে হলে সবার আগে পাল্টাতে হবে সামাজিক দিক থেকে নারীর সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা। দিতে হবে তাদের অধিকারের স্বীকৃতি। নারী-পুরুষের মর্যাদাবোধের ভারসাম্যহীনতা, নারীকে দুর্বল বলে ভেবে নেওয়া, তাদের মতামতকে গুরুত্ব না দেওয়া এ সবই সমাজের পরিকাঠামগত ত্রুটি। অসুস্থ সমাজের প্রভাব পড়ে ব্যক্তির মানসিকতায়। কম বয়সীদের ক্ষেত্রে এই প্রভাব আরো বেশি। তাই নারীরা শিকার হচ্ছে পুরুষের অবদমিত বাসনার।
মানসিকতা ও সামাজিক পরিকাঠামোর পরিবর্তন না আনলে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে না। নারীকে সম্মান করতে শিখলেই মূল্যবোধের আমূল পরিবর্তন হবে আমাদের, বদলে যাবে নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও। নারীর প্রতি সহিংসতা ও এর থেকে থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে কথা হয় সমাজে জেন্ডার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাওয়া ব্যক্তিত্ব, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি যখন জাতিকে ডুবিয়ে রাখে, তখন উত্তরণের আর পথ পাওয়া যায় না। আমরা তো আসলে সবকিছুই নিজেদের ক্ষমতার জায়গা থেকে দেখি। পুরুষ সব সময়ই নিজেকে নারীর চেয়ে ক্ষমতাধর মনে করে। এই ক্ষমতা ফলাতে গিয়েই তো নারীর ওপর সব রকম জোর খাটানোর চেষ্টা করে। ধর্ষক ধর্ষণ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। এতে এদের সাহস আরো বেড়ে যাচ্ছে। তবে এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এবার এটা বন্ধ করতে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা থেকে বেরিয়ে এসে দ্রুত বিচার আইনে কঠিন শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। অর্থাৎ ধর্ষককে বুঝিয়ে দিতে হবে তুমি যা করেছ তা ক্ষমার অযোগ্য এবং এর জন্য তোমাকে কঠিনতম শাস্তি পেতে হলো। তবে শুধু আইন দিয়ে এটা বন্ধ করা যাবে না। মূল্যবোধের অবক্ষয়টা রোধ করতে হবে। মূল্যবোধ তো আর একদিনে ফিরিয়ে আনা যাবে না! শুরু করতে হবে পরিবার থেকে। ন্যায়-অন্যায়বোধটা তৈরি করে দিতে হবে পরিবার থেকে। এ ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও দায়িত্ব আছে এখানে, যার গুরুত্ব অনেক।’
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে মানবাধিকার সংগঠক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, “ভারতে বাসে একটি নারীকে ধর্ষণের পর আমরা দেখেছি সেখানকার নাগরিক সমাজ ফুঁসে ওঠে। সেখানকার সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধভাবে ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। যেদিন ধর্ষিত নারীর লাশ বিমানবন্দরে পৌঁছায় সেদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, সরকারি দলের প্রধান নেত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা সবাই বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকেন। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে আমরা লক্ষ করছি, বাংলাদেশে অব্যাহতভাবে ধর্ষণ, গণধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও প্রতিবাদ জানাচ্ছে শুধু নাগরিক সমাজ। রাজনৈতিক দলগুলো এ ক্ষেত্রে প্রতিবাদী ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
রানা দাশগুপ্ত আরো বলেন, ‘ভারতে চাঞ্চল্যকর ওই ধর্ষণের ঘটনার পর বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠিত হয়। কমিশন যথাসময়ে সুপারিশ প্রণয়ন করে। বাংলাদেশেও অবিলম্বে এ ধরনের বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করা উচিত।’ প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আপনাদের কাছে আবেদন, আপনারা ধর্ষণ, নিপীড়ন, নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলুন।’