মেয়ের সুখের জন্য সবচেয়ে ভালো যৌতুক কী?
বাবা মা মেয়ের সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে মেয়ের সুখের জন্য যৌতুক দেন। মেয়েকে ভালো রাখতে সব যৌতুকের আবদার মেনে নেন। কিন্তু মেয়ের সুখের জন্য সবচেয়ে ভালো যৌতুক কী? বিষয়টি নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে।
মেয়ে মানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বোঝা। আর এই বোঝা দ্রুত কাঁধ থেকে নামিয়ে দায়মুক্ত হতে চান বাবা-মা। ফলে মেয়েকে সামর্থ্যর বাইরে গিয়েও যৌতুকের অর্থ জোগাড় করে যৌতুক দেন। অতি দরিদ্র পরিবারের পক্ষ থেকেও ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা কোথাও বা দামি তৈজসপত্র দেওয়া হয়। অনেক মা-বাবাই মেয়ের বিয়ের জন্য যে পরিমাণ অর্থ যৌতুক হিসেবে দেন তার কিঞ্চিতও মেয়েকে লেখাপড়া শেখাতে বা স্বাবলম্বী করতে খরচ করেন না।
মেয়ের জন্মের সাথে সাথে তার বিয়ের যাবতীয় প্রস্তুতি শুরু করে দেয় এমন পরিবারের সংখ্যা অগণিত। কিন্তু ছেলে সন্তানকে লেখাপড়া শেখানো হোক বা অন্যকোনো উপায়ে হোক স্বাবলম্বী বা উর্পাজনক্ষম করে তোলাই থাকে মূল লক্ষ্য। যৌতুক সমস্যার বীজ এখানেই রোপিত থাকে।
মেয়েকে বোঝা না ভেবে তার জীবন বিয়ের জন্য উৎসর্গ না করে যে টাকা যৌতুকের জন্য খরচ করা হয় তা দিয়ে মেয়েকে স্বাবলম্বী করা বা উপার্জনক্ষম করার প্রচেষ্টা করলেই পরিস্থিতি বদলে যায়। অনেক স্বচ্ছ্বল মা-বাবা আবার কন্যাকে লেখাপড়া শেখান তবে তা কেবল শেখানোর জন্যই। তাকে স্বাবলম্বী না করে বা উর্পাজনক্ষম না করে প্রতিষ্ঠিত কোনো সুপাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দেন। বাবার বোঝা মেয়ে স্বামীর ঘরে গিয়ে আবার বোঝা হয়ে উঠেন এবং তার শিক্ষার স্থান হয় আলমারিতে তোলা সার্টিফিকেটগুলোর সাথে।
সমাজের সব স্তরের প্রতিটা ছেলের মতো মা-বাবা যদি প্রতিটা মেয়েকেও স্বাবলম্বী বা উর্পাজনক্ষম না করে বিয়ে দেবেন না এমন পণ করেন তাহলে পরিস্থিতি বদলে যাবে। তখন আর বোঝা মনে করে সামর্থ্যর বাইরে গিয়ে যৌতুকের দাবি মেনে নিয়ে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। বরং মেয়ের সাথে সাথে মা-বাবাও শির উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। বলতে পারবে যৌতুক ছাড়া বিয়ে হলে বিয়ে দেব, না হলে নয়।
বিয়ের ১০ বছর, ১৫ বছর বা আরো বেশি সময় পরও যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন বা হত্যা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় দীর্ঘদিন ধরে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন সহ্য করার পর বাপের বাড়ি থেকে যৌতুক না আনার কারণে নির্যাতন এমনকি হত্যা পর্যন্ত হচ্ছে।
যৌতুকের দাবি মেনে না নিয়ে মেয়ে যদি বাপের বাড়িতে ফেরে তাহলে সমস্যাগুলো কোথায়? প্রথমত মেয়ে উপার্জনক্ষম না হলে পুরো দায়িত্ব মা-বাবা বা ভাইয়ের ওপর পড়বে। সন্তান থাকলে তাকে মানুষ করার দায়িত্ব নিতে হবে। সমাজের কাছে নিগৃহীত হবে। এখানেও সমস্যা একটাই। মেয়েটির আত্মবিশ্বাস বা স্বাবলম্বীতার অভাব। যেকোনো মূল্যে স্বামীর সংসারে টিকে থাকতে হবেই। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই- এই মনোভাব। স্বাবলম্বী হলে, আত্মবিশ্বাষী হলে যেকোনো মূল্যে টিকে থাকার চিন্তা থেকে নির্যাতন সহ্য করার কোনো প্রয়োজন পড়বে না। বিবাহিত জীবন হয়তো টিকবে না বা একা সন্তান মানুষ করার জন্য অন্য চ্যালেঞ্জ আসবে কিন্তু নারীর জীবন তো রক্ষা পাবে, নির্যাতনের হাত থেকে তো মুক্তি পাবে। আর নিজেই নিজের দায়িত্ব নিতে পারলে বাবা বা ভাইয়ের সংসারে বোঝা হওয়ার বিষয়টিও থাকবে না। ফলে যখন থেকে যৌতুক চাওয়ার শুরু তখন থেকে মেয়ের বাড়ি থেকে মানিয়ে নাও না বলে বলবে, প্রতিবাদ করো।
যৌতুক যারা দেয় আর যৌতুক যারা নেয় উভয়েই অপরাধী। যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিলেই মেয়ে ভালো থাকবে, সুখে থাকবে- এই ভাবনাটায় যারা যৌতুক দেয় সেটাই তাদের অপরাধ। মেয়ের জন্য সুখ যে তাকে আত্মবিশ্বাষী স্বাবলম্বী হয়ে বাঁচতে শেখানো তা বেমালুম ভুলে যাওয়াটাই অপরাধ। তাই যৌতুক যারা নেয় পাশাপাশি যৌতুক যারা দেয় উভয়েই সমান অপরাধী।
মেয়ের জন্মের সাথে সাথে তাকে বিয়ের জন্য উৎসর্গ না করে মানুষ হিসেবে বাঁচতে শেখানোই মেয়ের জন্য সবচেয়ে ভালো যৌতুক। পারিবারিক সামর্থ্য অনুসারে মেয়েকে স্বাবলম্বী করার প্রচেষ্টায় তাকে সুখে রাখার সূচনা। যৌতুকের জন্য যে বাড়তি চাপ নেওয়া হয় তেমন বাড়তি চাপ নিয়ে মেয়েকে আত্মবিশ্বাষী, উর্পাজনক্ষম, স্বাবলম্বী করে তোলায় তার সুন্দর জীবন গড়ে দেওয়া।
মেয়ে সত্যিকার অর্থেই ভালো থাকবে, সুখে থাকবে- এমনটা যে বাবা মায়েরা চান তাঁরা যৌতুক মেয়ের উন্নয়নের পিছনেই ব্যয় করলে পরিস্থিতি বদলে যাবে। মেয়ের সুখের জন্য বাবা মায়ের পক্ষ থেকে তাই সবচেয়ে ভালো যৌতুক- মেয়ের আত্মবিশ্বাস, স্বাবলম্বীতা আর উর্পাজনক্ষমতা।যা যৌতুক নির্যাতন নামক সমস্যাকে সমাজ থেকে দূর করতে দূঢ় ভূমিকা রাখবে।
লেখক : ফ্রিল্যান্স লেখক