দৃষ্টিপাত
শুধু কামান দাগালেই মশা মরবে?
একটি রিপোর্টের কাজে কদিন আগে গিয়েছিলাম রাজধানীর হাজারীবাগে। স্থানীয়রা জানালেন, মশার কামড়ে সেখানকার মানুষের জীবন রীতিমতো অতিষ্ঠ। বয়স্ক এক ব্যক্তি এগিয়ে এসে বললেন, প্রায় পাঁচ মাস আগে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হন, এত দিনেও সেই উপসর্গ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। এখনো মাঝেমধ্যে শরীরে যন্ত্রণা হয়। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত এমন অনেকেরই অভিজ্ঞতা হয়তো এমনই। কারণ, যাঁরা এতে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁরাই বুঝেছেন কষ্ট। গত বছর অনেকটা আশঙ্কাজনকভাবে দেখা দিয়েছিল এর প্রাদুর্ভাব। জাতীয় সংসদেও একাধিক মন্ত্রী এ নিয়ে ক্ষোভ জানান।
শীত শেষ হওয়ার পরপরই আবার রাজধানীতে মশার অত্যাচারে অস্থির হয়ে উঠেছে নগরবাসী। দিন নেই, রাত নেই প্রতিমুহূর্তেই চলছে এর অত্যাচার। বাসাবাড়ি, অফিস, খেলার মাঠ—সর্বত্রই মশা আর মশা। ‘রাতে মশা দিনে মাছি/এই নিয়ে বেঁচে আছি’—পদ্যটি যদি এখন লেখা হতো কবি হয়তো লিখতেন—রাতে মশা দিনেও মশা, এই নিয়ে ঢাকায় আছি। প্রাণিজগতে মানুষের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মনে হয় এই ক্ষুদ্র প্রাণীটির। তবে সে সম্পর্ক আত্মিক নয়, দৈহিক। মশার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক রক্তের। মশা মানুষের রক্তসম্পর্কের শত্রু। শত্রুকে ঘৃণা করা যায়, কিন্তু অবহেলা করা সম্ভব নয়। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলা, খালগুলো পরিষ্কার না হওয়া, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এবং ভবন নির্মাণসামগ্রী দিনের পর দিন ফেলে রাখায় দ্রুত বিস্তার হচ্ছে।
বাসাবাড়ি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মশার উৎপাত তো আছেই। এবার ফ্লাইট আটকে দিয়েছে মশা! গত ২২ ফেব্রুয়ারি ওড়ার আগমুহূর্তে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রানওয়ে থেকে ফিরিয়ে আনতে হয়েছিল মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট। মশা তাড়াতে দুই ঘণ্টা বিলম্বে ছাড়ে সেই বিমান। এবার মশার উৎপাত এত বেশি যে কয়েল, স্প্রে, মশা মারার ব্যাট কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। ফলে মনে ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে, আবারও চিকুনগুনিয়া ফিরে আসে কি না? কারণ মশার কামড় থেকেই ছড়ায় এই রোগ। অবশ্য এখন যেসব মশা কামড়াচ্ছে, যেগুলো সাধারণত কিউলেক্স মশা। তবে এডিস মশার উপদ্রপ যে আবারও শুরু হবে না, তা তো বলার কোনো উপায় নেই।
সাধারণত বাসাবাড়ির আঙিনা, ফুলের টব, ছাদের বাগান, ভবনের চৌবাচ্চা, এসি-ফ্রিজ থেকে জমা স্বচ্ছ পানিতে মশার বংশবিস্তার বেশি ঘটে এডিস মশার। আর চিকুনগুনিয়ায় বা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীকে সেই মশার কামড় দেওয়ার পর অন্য কাউকে কামড় দিলে তিনিও আক্রান্ত হতে পারেন।
মশার গড় আয়ু ধরা হয় ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে মাছি প্রজাতির এই পতঙ্গটি মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে ফেলে। শুধু ঢাকায় নয়, মশা মারতে কামান দাগার মতো পরিস্থিত তৈরি হয়েছে পৃথিরীর অনেক শহরেই। অধিকাংশ প্রজাতির স্ত্রী মশা মানুষের রক্ত পান করে থাকে। যদিও সেই রক্ত তুলনায় খুবই অল্প, কিন্তু কিছু মশা রোগজীবাণু সংক্রামক। তাই মশার কামড় তো কামড়ই। কোনটি কিউলেক্স আর কোনটি এডিস, কোনটি স্ত্রী, কোনটি পুরুষ খালি চোখে আর বোঝার উপাই নেই। ফলে এর মাধ্যমে চিকুনগুনিয়া ছাড়াও ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ফাইলেরিয়া, পীত জ্বর, জিকা ভাইরাস প্রভৃতি রোগ সংক্রমিত হয়ে থাকে।
এবার দুই সপ্তাহের ক্রাশ কর্মসূচি উদ্বোধনকালে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটির মশা এখনো নিয়ন্ত্রণে আছে। এই যদি হয় নিয়ন্ত্রণের অবস্থা, তাহলে না জানি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে কী হয়। তখন হয়তো মশাদের বসবাসের জন্য শহরটি ছেড়ে দিতে বাসিন্দাদের গ্রামে চলে যেতে হবে। সাঈদ খোকন নগরবাসীকে চিকুনগুনিয়া থেকে বাঁচতে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাহলে তো আর সিটি করপোরেশনের কোনো দায়িত্ব রইল না। কারণ তিনি বলবেন, আমি তো আগে আপনাদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম।
অবশ্য মেয়র থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা বরাবরের মতো এবারও দাবি করেছেন, মশা মারতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছেন তাঁরা। আর টাকা কোনো সমস্যাই না। অবশ্য গত কবছর নগরবাসীর অভিযোগ নিয়ম করে সকাল-বিকেল দুবেলা মশা নিধনে ওষুধ ছিটানোর কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। সিটি করপোরেশনের মশক নিধনকর্মীদের দেখা পাওয়া যায় না। আবার কোনো এলাকায় ওষুধ দেওয়া হলেও কার্যকারিতা না থাকায় প্রশ্নটি বারবারই উঠছে। গত অর্থবছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রায় ৩৬ কোটি টাকা মশক নিধনের জন্য বরাদ্দ ছিল।
মশার তাড়াতে অথবা এর উপদ্রুত থেকে রক্ষা পেতে রসুন, কর্পূর, নিমের তেল, পুদিনা, তুলসীর নানা প্রাকৃতিক ব্যবহার প্রচলিত আছে। তবে সবার পক্ষে তা জানা-বোঝা বা রাজধানীর বাস্তবতায় কার্যকর করা সম্ভব নয়। তবে অবশ্যই নাগরিক সচেতনতা জরুরি। সিটি করপোরেশনের ওপর ভরসা করে বসে থাকার উপায় নেই। কারণ নিজের সুরক্ষার বিষয়টি আগে নিজেদেরই ভাবতে হবে। এজন্য ব্যক্তি, পরিবার এবং সামাজিক উদ্যোগ জরুরি।
অবশ্য উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় মশা নিধনে হটলাইন চালু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। ০১৯৩২৬৬৫৫৪৪ নম্বরে ফোন করলে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নাকি ওই স্থানে মশার ওষুধ ছিটাতে পৌঁছে যাবে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও এলাকাভিত্তিক কর্মকর্তাদের ফোন নম্বর প্রচার করেছেন নাগরিকদের জন্য। এটা যদি মোটামুটিভাবে কার্যকর হয়, তাহলে নিশ্চয় মশা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
তবে বড় সমস্যা হলো রাজধানীর চারপাশে বয়ে যাওয়া নদী, খাল, ডোবা ও নালায় জমে থাকা ময়লা পানিতে ব্যাপক মশা জন্ম নেয়। সেখান থেকেই মশা রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়ছে। দুই সিটির কর্তাব্যক্তিরা এত দিন মশার প্রজননের এসব ক্ষেত্রগুলো তাদের আওতাধীন নয় বা এখতিয়ার নেই দাবি করে আসছিলেন। এখন যখন এসব এলাকাগুলোও দুই সিটির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেখানে মশা নিধনে কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে না কেন? তাহলে কি এসব এলাকার মশাগুলো অভিভাবকহীন ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বংশবিস্তার করে যাবে?
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার এটিএন নিউজ।