প্রতিক্রিয়া
প্রাণের এই দেশটার অভিভাবক কারা?
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত নিউজফিডের মন্তব্য দেখেও আজকাল গণমত যাচাই করা যায়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উগ্রবাদী এক যুবকের হামলায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও খ্যাতিমান লেখক ড. জাফর ইকবালের গুরুতর জখমের খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার হলে তা সর্বত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই এই ন্যক্কারজনক ঘটনার নিন্দা, দুঃখ প্রকাশ ও সমবেদনা জানাতে থাকেন। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, একজন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ও জনপ্রিয় লেখককে ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে চরম বিষোদগার করেছে বেশিরভাগ মানুষ, যা যেকোনো সভ্য সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্যই অশনিসংকেত। আমাদের জানা নেই, এই বিপথগ্রস্ত বিগড়ে যাওয়া নেটিজেনদের জন্য আইসিটি অ্যাক্টে কোনো বিধিব্যবস্থা আছে কি না? কারণ এমন দুষ্টুচক্র কারো বিরুদ্ধে আইনের বাস্তব প্রয়োগ আমরা দেখিনি।
ধর্মান্ধ, গোঁড়া বা উগ্রবাদীদের একক কোনো দল নেই। এরা না আওয়ামী লীগ, না বিএনপি, না জামায়াত, না হেফাজত! সবখানেই এরা ভাগাভাগি করে থাকে। নানা প্রলোভন বা প্রলুব্ধতার এই যুগে একজন ধর্মবিশ্বাসীর অসাম্প্রদায়িক, সহনশীল বা উদারবাদী হওয়া সত্যি দারুণ কঠিন ব্যাপার! যিনি সমস্ত প্রভাবকের ঊর্ধ্বে উঠে সর্বপ্রাণবাদী ও সকল জীবের প্রতি প্রেমময় হতে পারেন, তিনি মানুষ থাকেন। আর যারা পারে না, তারা নিউজফিডে মন্তব্যকারীদের মতো অমানুষ হয়ে ওঠে। অবিশ্বাস্য ও দুঃখজনক হলেও সত্যি, বাঙালির অধিকাংশই এখন এমন অমানুষ। যাঁরা একজন প্রাজ্ঞ শিক্ষকের প্রকাশ্যে অপঘাতে মৃত্যু চাইতে পারেন!
রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মিসগাইডিং-এর ফলেই দিন দিন ধর্মীয় শিক্ষাটা আদর্শবাদী ও নৈতিক না হয়ে ভিন্নমতের মানুষকে চরমভাবে ঘৃণা করতে শেখাচ্ছে! এর দায় এককভাবে কারো নয়। আমরা কেউই এর দায়মুক্ত নই। ফয়জুর নামের স্বল্পশিক্ষিত ও অপরিণত ছেলেটিকে আমরা ড. জাফর ইকবালের লেখালেখি বা চিন্তার সঙ্গে পরিচিত করাতে পারিনি। বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যা ছাড়া কেবল একপেশে ও একমুখী ধর্মীয় পারলৌকিক শিক্ষায় শিক্ষিত ওস্তাদরা ওর মগজে ঢোকাতে পেরেছেন যে, ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি ও কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে গিয়ে যাঁরা বিজ্ঞানের কথা বলবেন, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা করবেন, মানবিক দর্শন প্রকাশ করবেন তাঁদের মেরে ফেলা জায়েজ নয় শুধু, পরলোকে এমন ন্যক্কারজনক মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য মহান প্রভু বিরাট পুরস্কারের ব্যবস্থাও রেখেছেন। যার মগজের বিকাশ যতটুকু তার বুঝও ওই বিকাশের সমানুপাতিক। কাজেই ফয়জুরের মতাদর্শী সোশ্যাল মিডিয়ায় মন্তব্যকারীদের আসলে ঘৃণা করাটা কোনো কাজের কথা নয়। শিক্ষক জাফর ইকবালের ওপর আঘাত মানে আমার সমান বেদনা মনে করেও আমরা এদের সবাইকে ভালোবাসতে চাই। আমাদের আর উগ্রবাদীর মাঝে এটাই বৈপরীত্য যে, ওরা শুধু ঘৃণাই করতে শিখেছে, আর আমরা শিখেছি উজাড় করে ভালোবাসতে। ভালোবাসায় মানুষ বাঁচে ঘৃণায় কিছুতেই নয়!
ফয়জুয়ের নৃশংস আঘাতে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েও আমাদের প্রিয় জাফর ইকবাল স্যার ঘাতকের প্রতি পরম মমতা নিয়ে উচ্চারণ করেছেন :
ও আমার ছাত্র না তো? ওকে মেরো না!
মানুষের জন্য ভালোবাসা তো এমনই। এরূপ প্রেমময় মানুষ হওয়ার শিক্ষা জাফর ইকবালদের মতো মানুষেরাই দিতে পারেন। ফয়জুররা কি তা কোনোদিন অনুভব করবে?
মহত্তম ভালোবাসার দাবিতেই বলব, ভাইসকল ধর্মকে এত নিচে নামিয়ে দিতে আছে যে, মানুষ খুন করে ধর্মরক্ষার নামে উল্লাস করে যেতে হয়? আমার নবী (সা.) কি চৌদ্দশো বছর আগে আমাদের এমন শিক্ষা দিয়েছিলেন? খুন, যখম, বর্বরতার নাম কি শান্তির ধর্ম হয়?
যতটুকু পড়াশোনা করেছি, কোনো লেখাতেই দেখিনি লেখক জাফর ইকবাল পৃথিবীর কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস বা আমাদের মহানবী (সা.) -এর বিরুদ্ধে কিছু লিখেছেন বা বলেছেন। ধর্মের নামে একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসর আলবদর, আলশামস ও রাজাকাররা নিরস্ত্র নিরুপায় বাঙালির ওপর জঘন্য বর্বরতা চালিয়েছিল। ধর্মরক্ষার নাম নিয়েই প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল ৩০ লাখ মানুষের আর সম্ভ্রম লুটেছিল লাখো নারীর। একজন বিবেকবান মানুষের ধর্মের দোহাই দেওয়া এমন অনাচারের বিরোধিতা না করাটাই বরং ধর্মহীনতা। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বলয় স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও সাধারণ মানুষকে মনুষ্যেতর শিক্ষাটাই দিতে পারেনি। কার্যত অপশিক্ষার ফল আজকের উগ্রবাদের বাংলাদেশ।
ধরা যাক এমন আড়ষ্ট চিন্তার মানুষদের কাছে দেশের শাসনভার অর্পণ করা হলো! কী হতে পারে তখন? একযোগে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাবে! কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ও মানবিকবিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হয় যা ধর্মসম্মত নয়। পৃথিবীর সব ধর্মের সঙ্গেই বিজ্ঞানের বিরোধ আছে। থাকুক। তাতে আমাদের সামগ্রিক ধর্মপালন তো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না। কিন্তু উগ্রবাদীরা সবকিছুতেই শুধু নিষেধাজ্ঞা দেখে।
টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেল বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ সেখানে মানুষের মুখচ্ছবি দেখা যায়, যা ধর্মসম্মত নয়। বিধর্মীদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। কারণ মূর্তিপূজা বা যিশু/বুদ্ধের গুণকীর্তনও ধর্মসম্মত নয়। সামগ্রিকভাবে দেশে খুনোখুনির হিড়িক পড়ে যাবে। উগ্রধর্ম তো ভিন্নমতের বিনাশ দেখতে চায়।
ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, প্লেন, ট্রেন, গাড়ি, বিদ্যুৎ সব বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ এসবের আবিষ্কর্তা ইহুদি/খ্রিস্টান। যাদের শুধু ঘৃণাই করে যেতে হবে।
তাহলে অনুভব করা যাচ্ছে, দেশ যদি উগ্রবাদের উর্বর ভূমি হয়ে ওঠে তবে আমরা পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে এক অন্ধকার গুহাবাসী হয়ে উঠব। আধুনিক পৃথিবীতে যা অসম্ভব ও অবাস্তব। পশ্চাৎপদ রক্ষণশীলতা নয় দিন এখন আধুনিক ও প্রগতিশীল উদারতাবাদের। উগ্রবাদীদের এটা কে বোঝাবে?
আমাদের ধর্মের আঁতুড়ঘর খোদ সৌদি আরবকেও ‘ইহুদি ইসরায়েল’ ও ‘খ্রিস্টান আমেরিকা’র সঙ্গে সখ্য রেখে চলতে হয়। ইসলামবিরোধী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসে রাষ্ট্রীয় জলসায় ট্রাডিশনাল তরবারি ড্যান্স করতে হয়। সৌদি রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছে ‘খ্রিস্টান/নাছাড়া’ অধ্যুষিত সেই ব্রিটেনের কাছে মুচলেকা দেয়ার মাধ্যমে। খুব স্বাভাবিকভাবেই ধর্মরাষ্ট্রের ধর্মরক্ষার খাতিরেই বৈধার্মিকদের সঙ্গে প্রীতি রেখে চলতে হয়। আর সেখানে আমরা বাঙালিরা সৌদি থেকে আসা কনভার্টেড ধর্মধারী হয়েও ভিন্নমতের মানুষকে কেবল ঘৃণা করাই রপ্ত করে চলেছি। এভাবে আসলে আমরা আমাদের কোন তিমিরে নিয়ে যাচ্ছি?
বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র কিংবা দেশের পবিত্র সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র কি তার সেই অবস্থান বদল করে একটি বিশেষ ধর্মে স্থিতি লাভ করেনি? তাহলে আমরা আর আশা করি কীভাবে যে, সর্বজনের ও সর্বমতের সুন্দর সহাবস্থান হবে এই বাংলাদেশ? বরং এখানে আমি ও আমরা সবাই অপঘাতে মৃত্যুর নিয়তি বয়ে বেড়াচ্ছি!
কাজেই ফয়জুর তথা সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজফিডে মানবতাবিরোধী বিরূপ মন্তব্যকারী সাধারণের আর দোষ দেখি না। ওরা তো সামান্য ক্রীড়নকমাত্র। যারা ওদের নিয়ন্তা ও যারা দেশের ভাগ্য নির্ধারক তাদের দায় সবার আগে। রাষ্ট্রযন্ত্র অথবা দেশের অভিভাবকশ্রেণি যদি তাদের সেই দায় মেটায় তবেই কেবল হতে পারে তরুণদের প্রেরণাস্থল লেখক ও অধ্যাপক জাফর ইকবালের শরীর থেকে ঝরে যাওয়া রক্তের দায়শোধ।
সবার ক্লীব ও নির্লিপ্ত হয়ে যাওয়া মগজের নিউরনে বোধ ও বিবেক ফিরুক! এতটুকু ঘৃণা নয় অন্তর বিকশিত হোক আলো আর ভালোবাসায়।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।