এক্সট্রা কাভার
এড়াতে হবে স্বার্থের দ্বন্দ্ব
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ঘোরতর বিরোধী লোকটাও মানবেন, বাংলাদেশ ক্রিকেটে আজ আক্রমণাত্মক যে ধরনটার আমদানি ঘটেছে তার পেছনে বিপিএলের একটা বড় ভূমিকা আছে। আবার এটাও সত্যি বিপিএল বাংলাদেশ ক্রিকেটে এমন একটা কালির ছোপ ফেলেছে; যা ‘ট্রাইবুনাল’ নামক সার্ফ এক্সেল দিয়েও ওঠানো যাবে না! তা স্পট ফিক্সিংয়ের দায়ে মোহাম্মদ আশরাফুলের মতো দু-একজনকে কয়েক বছরের জন্য যতই নিষিদ্ধ করা হোক। ভারতীয় ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত এবং ফেরারি লোলিত মোদির মস্তিষ্কজাত ক্রিকেটীয় ললিত-কলা হচ্ছে আইপিএল। অজস্র কেলেঙ্কারি প্রমাণিত হওয়ার পর সেই আইপিএলকে এখন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের পরিবর্তনে বিশ্ব গণমাধ্যমেও বলা হচ্ছে ‘ইন্ডিয়ান প্রবলেম লিগ’! সেই আপিএলের অনেকটা (বাংলাদেশি) কার্বন কপি হচ্ছে বিপিএল। এবং সেটা নিয়েও বাংলাদেশ ক্রিকেটে অনেকটা বড় এক প্রবলেম তৈরি হয়ে বছর দুয়েক বন্ধ ছিল। আবার নতুন করে সেই বিপিএল শুরুর উদ্যোগ নিয়েছেন বিসিবি কর্তারা। টি-টোয়েন্টিপ্রেমীদের জন্য নিঃসন্দেহে ভালো খবর। তবে পাশাপাশি একটা শঙ্কাও থাকছে- আবার বাংলাদেশ ক্রিকেটে কোনো ‘প্রবলেম’ তৈরি হবে না তো বিপিএল নিয়ে?
বিপিএল নিয়ে নতুন প্রবলেম তৈরি হওয়ার আগেই প্রশ্ন উঠেছে পুরোনো সমস্যাগুলোর ঠিকঠাকমতো সমাধান হচ্ছে তো? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে স্বচ্ছতা নিয়ে। আগের দুটি আসরের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, সেই ‘গেম অন’-এর মালিকানা কাদের ছিল তা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা! তাদের কাছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পাওনা-দেনা কী আছে, সেটাও পরিষ্কার করা উচিত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের। আগের দুটি আসরের টেলিভিশন সম্প্রচার স্বত্ব যাঁরা কিনেছিলেন, তাঁদের কাছে কোনো পাওনা দেনা আছে কি না। যেমনভাবে বলা হচ্ছে, আগের ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর কাছে বিসিবি এবং ক্রিকেটারদের পাওনা আছে। সেগুলো শোধ না করলে তারা এবার ফ্র্যাঞ্চাইজি থাকতে পারবে না। নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি নেওয়া হবে। এবং সেই প্রক্রিয়া খানিকটা শুরুও হয়েছে। ফ্র্যাঞ্চাইজি কিনতে আগ্রহীদের নাম জানতে একটা বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আগ্রহী ১১টা প্রতিষ্ঠানের নামও ঘোষণা করা হয়েছে বিপিএলের গভর্নিং কাউন্সিলের সভা শেষে। পরবর্তী সময়ে হয়তো চূড়ান্ত করা হবে ফ্র্যাঞ্চাইজিদের নাম। তবে তার আগে প্রশ্ন, পাওনা টাকা পরিশোধ না করলে ফ্র্যাঞ্চাইজি শুধু মালিকানা হারাবে নাকি পাওনা অর্থ আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেবে বিসিবি। এই বিষয়টা আরো পরিষ্কার করে বললে অন্তত ক্রিকেটপ্রেমীদের বুঝতে সুবিধা হতো বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে ব্যবসা করতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা মূলত ক্রিকেটার, ক্রিকেট বোর্ডের পয়সা ফাঁকি দিয়ে নিজেদের পকেট ভর্তি করতেই এসেছিলেন। এঁদের কাছ থেকে যদি পাওনা আদায় করা না যায়, তাহলে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ-বিপিএল শুধু ‘বাংলাদেশ প্রবলেম লিগ’ হয়ে থাকবে না আগামীতে এটা বাংলাদেশ লুট-পাট লিগে পরিণত হতে পারে।
বিপিএল ঘিরে সমস্যা শুধু স্পট ফিক্সিং নিয়ে ছিল, তা নয়। আরো অনেক সমস্যাই ছিল। সেই সমস্যাগুলোর সঠিক সমাধান করা না গেলে আগামীতে আরো বড় সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াতে হতে পারে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে। কারণ, জবাবদিহিহীনতার সংস্কৃতি ক্রিকেটের জন্যও ভালো কিছু হতে পারে না। কোন ফ্র্যাঞ্চাইজির কাছে কী পাওনা-দেনা আছে সেটা জানার অধিকার এ দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের আছে। আর গত দুটো আসরে যে সমস্যাগুলো বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল তার মূল কারণ, কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। বাংলায় বললে বলতে হবে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। বোর্ড কর্তা থেকে বোর্ডের চাকরিজীবীরা পর্যন্ত যখন বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজির পেটের মধ্যে ঢুকে যান, তখন স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিতে বাধ্য। ক্রিকেটের স্বার্থ, ক্রিকেটারদের স্বার্থ, বোর্ডের স্বার্থের চেয়ে তাঁদের কাছে ফ্র্যাঞ্চাইজির স্বার্থ অনেক বড় হয়ে দেখা দেয়। শুরু হয় স্বার্থের দ্বন্দ্ব। অনিয়মের উৎসও মূলত সেখানে। আইপিএলের অনিয়ম নিয়ে ভারতের উচ্চ আদালতের রায়েও সেটা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে। তাই বিপিএল ঘিরে অনিয়ম দূর করার সবচেয়ে বড় ওষধ হচ্ছে, কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের ব্যাপারে বোর্ড কর্তাদের আরো বেশি সতর্ক থাকা। তা না হলে বিপিএল মানে সত্যিই বাংলাদেশ প্রবলেম লিগ হয়ে যেতে পারে, যেটা ক্রিকেটানুরাগীদের কাছে মোটেও কাম্য নয়।