প্রতিক্রিয়া
শিশুরাই সুন্দর আগামীর সম্ভাবনা
একের পর এক শিশু হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা অতীতের সব বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের বর্বরতা বিচ্ছিন্নভাবে একটি-দুটি নয়, কয়েকদিন ধরে শিশুদের ওপর যে চরম বর্বরতা চলছে তাতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে; আমাদের মধ্যে ন্যূনতম মানবতা উধাও হয়ে যাচ্ছে। অথচ শিশুরাই আমাদের সুন্দর আগামীর সম্ভাবনা। শিশুরা সুগন্ধ ও সুন্দরের প্রতীক। নিসর্গ আনন্দের উৎস। শিশুদের সুন্দরতম মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াসেই আমাদের পথচলা। প্রতিটি শিশুর সঠিকভাবে গড়ে ওঠার জন্য আমাদের কিছু দায়িত্ব রয়েছে। বিশেষ করে স্নেহ-ভালোবাসা, পরিচর্যা, নিরাপত্তা ও সঠিক দিকনির্দেশনা। এক কথায় একটা সুস্থ পরিবেশ ও নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ দারিদ্র্যপীড়িত পরিবার তাদের শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে না। এমনকি দারিদ্র্যের কশাঘাতে সন্তানের মুখে দুবেলা দুমুঠো আহারও তুলে দিতে পারে না। বাধ্য হয়ে তারা তাদের শিশু সন্তানকে উপার্জনে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু সেই কর্মস্থল শিশুদের জন্য কতটা নিরাপদ সেটা নিয়ে কেউ ভাবে না।
নিরাপত্তার বিষয়টি আসছে এ কারণে যে, আমাদের দেশে শিশু নির্যাতনের একটি বড় জায়গা হচ্ছে তাদের কর্মক্ষেত্র। অর্থাৎ শিশুরা যেখানে শ্রম দেয় বা কাজ করে। নিজেদের কর্মক্ষেত্রে শিশুরা নির্যাতিত হয় তাদের নিয়োগকারীদের দ্বারা। কিছু মানুষের নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা ও মানবিকতার অভাব প্রধানত এর জন্য দায়ী। এসব মানুষের দ্বারা আমাদের দেশে শিশু নির্যাতনের যেসব ঘটনা ঘটছে, সেগুলো যেমনি ভয়াবহ তেমনি উদ্বেগজনক।
এ জন্য আমাদেরকে সর্বপ্রথম শিশু নির্যাতনের উৎস খুঁজে বের করতে হবে। কারণ উৎস খুঁজে বের করতে পারলেই নির্যাতনের বিস্তৃতি ও প্রতিকার করা সম্ভব হবে। আমাদের সমাজে শিশু নির্যাতনের উৎস খুঁজতে গেলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কিছু হৃদয়বিদায়ক দৃশ্য। বিশেষ করে বাসাবাড়ি, শহরে-বন্দরে, হোটেল-রেস্তোরাঁ, কল-কারখানায়, ইট-ভাটায়, গাড়ির গ্যারেজে, বাস-লঞ্চ টার্মিনালে, ফুটপাতে ইত্যাদি জায়গায় এ চিত্র ফুটে উঠে। অথচ এদের অধিকাংশই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লিপ্ত। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জন্য দুমুঠো খাবার জোগাড় করার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজ করে। তারপরও অধিকাংশ শিশু ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হয়। এমনকি কাজে সামান্যতম অবহেলা বা ভুল-ত্রুটির কারণে এই শিশুরা মালিকদের দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। অথচ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যে কোনো দেশে শিশুশ্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
গত দুই সপ্তাহে বিভিন্ন গণমাধ্যমে, শিশু হত্যা ও নির্যাতনের বেশ কটি লোমহর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। শিশুদের মধ্যে মেয়ে শিশুরা শুধু হত্যা বা নির্যাতনের শিকার হয় বিষয়টি তেমন নয় বরং তাদের ওপর ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনাও ঘটে।
সম্প্রতি সময়ে সিলেটে কথিত চুরির অপরাধে শিশু রাজনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে ও নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। যার ভিডিওচিত্র প্রকাশ নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ঠিক তার রেশ কাটতে না কাটতেই খুলনায় আরেক শিশু রাকিব হত্যার হৃদয়বিদায়ক চিত্র ফুটে ওঠে। এসব ঘটনায় গোট দেশ যখন ক্ষোভে উত্তাল, তখন আবার বরগুনার ১১ বছরের শিশু রবিউলকে চোখ উপড়ে ফেলাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে হত্যা ও লাশ পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। কত নির্দয় হলে মানুষ এমন নির্যাতন করতে পারে! এত পৈশাচিক নির্যাতন কীভাবে মানুষ হয়ে মানুষের দ্বারা সম্ভব?
সভ্য-সহনশীল বলে যে মানবজাতিকে বিবেচনা করা হয়, সেই মানুষের একটি শ্রেণীর হিংস্রতা পশুকেও হার মানিয়েছে। মানুষরূপী ওই নরপিশাচদের ক্রোধ, হিংসা, নৃশংসতা, বর্বরতা পৌঁছেছে চরমে। এ ধরনের নৃশংসতা আবারও মানবতায় চরম আঘাত হেনেছে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্যমতে, দেশে গত সাড়ে তিন বছরে ৯৬৮ শিশু হত্যা করা হয়েছে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে ১৯১ শিশুকে; ১১ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। গত সাত মাসে ধর্ষণের শিকার ২৩০ শিশু; ৬২ শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে; ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১৭ শিশুকে। অপহৃত হয়েছে ১২৭ জন শিশু; অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৩ জন শিশুকে। এ পরিসংখ্যান আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির জন্য উদ্বেগজনক। যেভাবে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, তাতে সামাজিক প্রতিরোধের বিকল্প নেই। যে কোনোদিন আমাদের আপনজনও এ রকম বর্বরতার শিকার হতে পারে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই শিশুর প্রতি নৃশংসতা ঠেকাতে হবে। শুধু হত্যাকাণ্ড নয়, সব ধরনের অন্যায়, অবিচার, অনাচারের বিরুদ্ধে সামাজিক সংহতি প্রয়োজন।
দিন যত যাচ্ছে, ততই আমাদের সংস্কৃতিতে শিশু নির্যাতনের বিস্তৃতি ঘটছে। বিশেষ করে শিশুদের কর্মক্ষেত্র ও নিজ পরিবারের মধ্যে এই প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা রীতিমতো উদ্বেগজনক। এসব শিশু নির্যাতনের যে ভয়াবহতা তা যে কোনো সভ্য-শিক্ষিত সমাজের জন্য কলঙ্কস্বরূপ। শিক্ষা-সংস্কৃতির দিক থেকে আমরা যতদূরই অগ্রসর হই না কেন, আমাদের সব অগ্রযাত্রা ম্লান হয়ে যায় এসব নির্যাতনের দৃশ্যপটের সামনে। এ দেশে শিশু নির্যাতনের চিত্র কতটা ভয়াবহ এবং কতভাবে হতে পারে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। দেশে প্রায়ই পারিবারিক কলহের জের ধরে নির্যাতনের শিকার হয় শিশুরা। অনেক সময় নিজ পরিবার কর্তৃক শিশুরা নির্যাতনে শিকার হয়। এই ধরনের নির্যাতনের দুটি রূপ দেখা যায়। কোনো কোনো পরিবারে বাবা-মা জেনেবুঝে-জ্ঞাতসারে তাদের শিশু সন্তানকে নির্যাতন করে। সাধারণত অশিক্ষিত-দারিদ্র্যপীড়িত সমাজে এই চিত্র বেশি দেখা যায়। তবে এসব বাবা-মা জানেও না যে তারা যেটা করছে সেটা আইনত অপরাধ।
আবার কোনো কোনো বাবা-মা অজ্ঞাতসারে তাদের শিশুসন্তানকে নির্যাতন করছেন। সাধারণত শিক্ষিত সমাজে এই ধরনের শিশু নির্যাতনের চিত্র দেখা যায়। এর কারণ সন্তানকে নিয়ে বাবা-মায়ের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তাঁর সন্তানকে সবচেয়ে ভালো ফলাফল করতে হবে। নাচ-গান, আবৃত্তি-বিতর্ক ও খেলাধুলায় ভালো হতে হবে। পরিবার তথা মা-বাবার এই ধরনের মানসিকতার কারণে নিষ্পেষিত হয় সন্তানরা। অথচ এটা সেই বাবা-মায়েরা কখনো চিন্তা করে দেখেন না। একটু ভেবে দেখেন না যে; তারা যা চাইছেন তার সবকিছু করার মতো ক্ষমতা শিশুটির আছে কি না। আবার এ ক্ষেত্রে সন্তানদের নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা মনোভাব তৈরি করার জন্য মূলত দায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকরা। সরকারি প্রাইমারি স্কুল বাদে আজকাল সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যসূচি নির্ধারণে কোমলমতি শিশুদের মানসিকতার দিকটা মোটেও বিবেচনায় আনা হয় না। শিশুদের নিয়ে দিন দিন এই প্রতিযোগিতা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা নিয়ে বরাবরই উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে।
এভাবে শিশু হত্যা, নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়া একদিকে যেমন আমাদের সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়, তেমনি এটিও সত্য, অপরাধ করে অপরাধীরা সহজে পার পেয়ে যাওয়ায় অপরাধ কমছে তো না-ই, বরং বাড়ছে। এ ছাড়া আমাদের অপসংস্কৃতির দৌরাত্ম্যে এ ধরনের অপরাধকে আরো উৎসাহিত করছে। এই অবস্থায় বিপণন হচ্ছে আমাদের শিক্ষা, মূল্যবোধ আর বিবেক। কোনো মূল্য নেই এসব অর্জিত মেধার, যা অন্যের কল্যাণে আসে না, জাগ্রত হয় না, প্রতিবাদ করে না। অপরাধ নির্মূলে সাহসী হয় না। এই হত্যা-নির্যাতনরোধে ব্যক্তি ও সমাজের দায়িত্ব রয়েছে। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এটা ব্যক্তিবিশেষের সমস্যা নয়। সমাজের সমস্যা। রাষ্ট্র এবং জনগণ মিলেই শিশু হত্যা-নির্যাতনের বিভীষিকা রোধ করতে হবে।
এসব নৃশংস ও পৈশাচিক কায়দায় খুনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও আইনের শাসন দায়ী। বিচারের ভয়হীনতা এ ধরনের অপরাধ সংগঠনের পেছনে কাজ করছে। এ ধরনের নির্মম ও বর্বর ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত ও গণমাধ্যমে সতর্কতার সঙ্গে সংবাদ প্রকাশ করার মাধ্যমেই এ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এসব অপরাধ থেকে সমাজ ও দেশ মুক্ত হতে পারবে না। এসব বর্বরতা-নৃশংসতা সামাজিক ও মানবিক বিপর্যয়েরই প্রতিচ্ছবি। মানুষ যখন অমানুষের মতো আচরণ করে, তখন সমাজে এমন বর্বরতা বাড়তে থাকে। এর লাগাম টেনে না ধরলে একপর্যায়ে তা মহাবিপর্যয়ে রূপ নেবে।
কবি সুকান্ত এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন। পাকিস্তানের নোবেল বিজয়ী কিশোরী মালালা ইউসুফজাই, কৈলাস সত্যার্থীসহ অনেকেই শিশুর অধিকার রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। জাতিসংঘ সারা বিশ্বে শিশু-নির্যাতন রোধ ও শিশু-অধিকার বাস্তবায়নে নানাবিধ কর্মসূচি পালন করছে। বাংলাদেশও শিশু-নির্যাতন প্রতিরোধ এবং শিশু-অধিকার রক্ষার জন্যে কাজ করছে। কিন্তু সমাজের মানুষ নামের কিছু অমানুষ তাদের পাশবিক তৎপরতার মাধ্যমে শিশু-অধিকার ক্ষুণ্ণ করছে। শিশুদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে, জীবনকে হুমকিতে ফেলছে। এই নরপশুদের দমন করতে না পারলে এই সমাজ, এই দেশ শিশুদের জন্যে সত্যিকার অর্থে বাসযোগ্য হবে না। পদে পদে শিশুদের জীবনে নিরাপত্তাহীনতার হুমকি থেকেই যাবে। আমাদের সমাজ যে শিশুর প্রতি সদয় নয়, তার অনেক নজির রয়েছে। অধিকন্তু সমাজে হত্যাপ্রবণ ও বিকৃত মানসিকতা বেড়েই চলছে।
এসব ঘটনার বিচারহীনতার কারণ থাকতে পারে। অনেক সময় বিচার হয় না। আবার হলেও তাড়াতাড়ি হয় না। অপরাধে জড়ানোর জন্য সেগুলো অন্যদের উৎসাহ দেয়। সমাজে একদল লোক আছে যারা অপরাধ করেই যাবে। কিন্তু তাদের জন্য আমাদের দৃঢ় হতে হবে। ঝটপট তদন্ত করতে হবে। তাড়াতাড়ি বিচার করতে হবে। মানুষকে দেখাতে হবে এমন জঘন্য কর্মকাণ্ড করলে রক্ষা পাওয়া যায় না, সাজা তাড়াতাড়ি হয়।
আমরা চাই দেশে প্রচলিত শিশু নির্যাতনবিরোধী আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত হোক, বন্ধ হোক বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের মতো ঘটনা। প্রতিটি শিশু বেড়ে উঠুক নিজের সবটুকু অধিকার ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নিয়ে। কারণ আজকের শিশুরাই আগামী দিনের স্বপ্ন। তাই সেই স্বপ্ন দেখার রাস্তা বন্ধ করে জাতিকে অন্ধকারে রাখবেন না। নিজের সন্তানকে যেমন ভালোবাসুন; তেমনি রাস্ত বা বাড়ির পাশের শিশু সন্তানকেও ভালোবেসে কাছে টেনে আনুন।
লেখক : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।