অভিজ্ঞতা
জাতিসংঘ ও আলী বাবা
ইরাকের রাজধানী বাগদাদ শহরে কারাদে দাখিল ও কারাদে খারিজ নামে দুটি প্রশস্ত সরণি রয়েছে। ওই সরণি দুটির সংযোগস্থলে একটি বৃহদাকায় নারী মূর্তি রয়েছে। তিনি হলেন আরব্য রজনীর আলীবাবা ও চল্লিশ চোরের মর্জিনা। তাঁর চারপাশে রয়েছে চল্লিশ চোরের চল্লিশটি মটকা।
আলী বাবা ও চল্লিশ চোরের কাহিনীতে আলী বাবা হলেন নায়ক এবং রক্ষাকর্তা। কিন্তু ১৯৯৬ সালে জাতিসংঘে মিশনে বাগদাদে গিয়ে আমরা দেখলাম ভিন্ন চিত্র। সেখানে আলী বাবা হলেন চোরদের প্রতীক। কেউ কাউকে আলী বাবা বললেই প্রচণ্ড ক্ষেপে যায়। দু-একবার বলে আমরাও বিপদে পড়েছিলাম। তবে কী কারণে স্বয়ং আলী বাবা নিজেই চোরের প্রতীক হলেন তা জিজ্ঞাসা করার সাহস আমাদের ছিল না।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিল রেজুলেশন ৯৮৬ অনুযায়ী ১৯৯৫ সাল ‘তেলের বিনিময়ে খাদ্য’ কর্মসূচি চালু হয়। আপাতদৃষ্টিতে এই কর্মসূচি জাতিসংঘ কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ন করা হলেও পরে তার পেছনের শক্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের প্রশাসন। দৃশ্যমান উদ্দেশ্য অত্যন্ত মহৎ। তেল বিক্রির টাকা সাদ্দামের হাতে না দিয়ে সরাসরি গরিবদের মাঝে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য মানবিক প্রয়োজনের সামগ্রী বিতরণ করা। কিন্তু আদতে তা রূপলাভ করে ‘তেলের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি স্ক্যান্ডালে’। সাধারণ ইরাকিরা এ মর্মে অভিযোগ করে বসে যে এ কর্মসূচিতে প্রাপ্ত লভ্যাংশের সিংহভাগই সাদ্দাম সরকার ও জাতিসংঘের কর্তাব্যক্তিরা আপসে ভাগাভাগি করে নিয়েছে। তাই আর কী করা। কপাল দোষে ইরাকে গিয়ে ‘আলী বাবা’ নাম ধারণ করতে হয়েছিল। পোশাক পরা অবস্থায় রাস্তায় দেখা হলে অনেকেই হেসে হেসেই বলতেন ‘ইমামুল মুত্ত্বাহিদা-আলী বাবা’। অগত্যা মেনে নিয়ে নিজেরাও হেসে হেসে কুশলবিনিময় করতাম।
২০০০ সালে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর আমরা কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের মনটেরে শহরে অবস্থিত নেভাল পোস্ট গ্রাজুয়েট স্কুলে জাতিসংঘবিষয়ক একটি কোর্সে অংশগ্রহণ করতে যাই। সেখানে জাতিসংঘের অর্গানোগ্রাম নিয়ে লেকচার দিতে গিয়ে একজন যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রশিক্ষক বললেন, ‘মানুষ মনে করে কফি আনান (সেক্রেটারি জেনারেল-১৯৯৭-২০০৬) পৃথিবীর প্রেসিডেন্ট, আসলে তিনি জাতিসংঘ সদর দপ্তরের স্টাফ প্রধান ছাড়া কিছুই নন’।
জাতিসংঘের কি আসলেই কোনো ক্ষমতা আছে? প্রথমেই দেখা যাক জাতিসংঘের স্টাফদের কে বেতন দেন। টপ ২৫টি দেশের মধ্যে প্রথমেই আছে যুক্তরাষ্ট্র, যা পুরো বাজেটের ২২ শতাংশ প্রদান করে। আর সর্বনিম্ন আছে ভারত, যা দশমিক ৭৪ শতাংশ কনট্রিবিউট করে। এই টপ ২৫টি দেশ যদি অর্থ সাহায্য না করে তাহলে জাতিসংঘ একটি দেউলিয়া সংস্থায় পরিণত হবে। সম্মানিত পাঠক তা হলে বুঝতেই পারছেন জাতিসংঘ সদর দপ্তর ঢাকা না হয়ে নিউইয়র্কে কেন।
২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে শান্তিরক্ষী মিশনে সর্বমোট বাজেট ছিল ৮.২৭ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে ১৫টি মিশনে প্রায় ৮৩ হাজার শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। আর এ টাকা কারা দেয় জানেন কি? টপ এইট এসব দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র (২৮.৪৭%), চীন (১০.২৫%), জাপান (৯.৬৮%), জার্মানি (৬.৩৯%), ফ্রান্স (৬.২৮%), যুক্তরাজ্য (৫.৭৭%), রাশিয়া (৩.৯৯%) এবং ইটালি (৩.৭৫%)। এই টপ এইট দেশ বিভিন্ন মিশনে ফাইন্যান্স করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ সিয়েরা লিয়নের মিশনে সহায়তা করেছিল যুক্তরাজ্য, আর হাইতি মিশনে সহায়তা করেছিল যুক্তরাষ্ট। তাহলে এই টপ এইটরা যা বলবে তা-ই হবে, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত স্টাফরা অনেকটা লুটপুটে খেয়ে নেয়। মিশন দেশের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষগুলো তা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে। আর এ জন্যই ইরাকে এমনকি সিয়েরা লিওনেও লোকেরা জাতিসংঘকে ‘আলী বাবা’ বলে জানে।
অনেক সময় অর্থ লুটপুটে খাওয়ার জন্য কৌশলে মিশন চালুর বন্দোবস্ত করা হয়। মিয়ানমার জাতিসংঘের প্রধান সমন্বয়কারী রেনেটা লকের কথাই ধরুন। গত চার বছর তিনি মিয়ানমার বসে বসে অনেক অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন। মিয়ানমারে জাতিসংঘ অফিসের কর্মকর্তাদের তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলতে বারণ করেছেন। এমনকি তিনি তাঁদের এলাকা ভিজিটে যেতে দেননি। তিনি শরণার্থী অধিকারের বিষয়টি মিয়ানমার সরকারের কাছে উত্থাপনেও বাধা দিয়েছেন। আর ইত্যবছরে মিয়ানমার গণহত্যা চালিয়ে ইতিহাসের জঘন্যতম জেনোসাইড ঘটিয়েছে। ২০০৭ সালে বাংলাদেশেও তিনি বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন। খোদ জাতিসংঘের স্টাফই এমন অপকর্মে লিপ্ত হয়ে বিবদমান দলগুলোর মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে দেন। তারপর জাতিসংঘ মিশন চালু করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়। তারপর শুরু হয় অর্থ লুটপাট।
জাতিসংঘের বিরুদ্ধে মোটা দাগে ৫টি অভিযোগ কিংবা সমালোচনা রয়েছে। এগুলো হলো (১) আসলে জাতিসংঘকে নিয়ন্ত্রণ করে ‘এলিট কান্ট্রি’ নামে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য। এ সব দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স ও রাশিয়া। এই পাঁচ স্থায়ী সদস্যগুলোর ইচ্ছার ওপরই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কাজ করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯১ সালে ধনী দেশ কুয়েত রক্ষায় জাতিসংঘ যতটা তৎপর ছিল, ততটা তৎপর ছিল না ১৯৯৭ সালে গরিব দেশ রুয়ান্ডায় শান্তি আনয়নের ক্ষেত্রে। (২) ভেটো পাওয়ারের ক্ষেত্রেও বিদ্যমান রয়েছে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। এই পাঁচ দেশের মধ্যে কোনো একটি দেশ কোনো একটি বিষয়ে ভেটো দিলেই হলো। এর ওপর আর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই জাতিসংঘের। আমাদের আজকের এই বার্মা ইস্যুও ভেটো ফ্যাক্টরেই আটকে আছে। এটা অন্যায় নয় কি? (৩) আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হলো জাতিসংঘের নির্লিপ্ততা এবং প্রতিরোধ করার অক্ষমতা। আমরা যদি ১৯৭১ সালের দিকে ফিরে যাই, তা হলে এর জ্বলন্ত প্রমাণ পাব। আজ হালের রোহিঙ্গা ইস্যুতেও আমরা জাতিসংঘের নির্লিপ্ততা অবলোকন করছি। (৪) জাতিসংঘে নিয়োজিত শান্তিরক্ষী ও স্টাফদের বিরুদ্ধে মোতায়েনকৃত দেশে চরম যৌন হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। (৫) লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট, জাতিসংঘের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অভিযোগ হলো দুর্নীতি। জাতিসংঘে এক একজন সাধারণ স্টাফের বেতন লাখ লাখ টাকা। তারপরও তারা আকণ্ঠ দুর্নীতিতে লিপ্ত থাকছে, মোতায়েনকৃত দেশে জাতিসংঘের সম্পদ ও অর্থ তারা নির্দয়ভাবে অপচয় করছে। মিশন দেশের জনসাধারণ যেখানে একবেলা পেট ভরে খেতে পারে না, জাতিসংঘের স্টাফরা সেখানে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে।
সর্বশেষে আসা থাক হালের রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে। ১৯৭৮ সালে এই সমস্যা চরম আকার ধারণ করলেও এ পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। আগের রোহিঙ্গারা তো ফিরে যায়ইনি, অধিকন্তু নতুন নতুন রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে প্রবেশ করছে। ২০১৭ সালে আমরা এ বিষয়ে নিয়ে যে পরিমাণ সিরিয়াসনেস দেখেছি, অতীতে তেমনটা হয়নি। কিন্তু কেন? এই কেন’র উত্তর খুব সুখকর নয়। নিন্দুকেরা বলেন, ইচ্ছে করেই এ সমস্যা জিয়ে রাখা হচ্ছে। ফলে জাতিসংঘের স্টাফরা থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ স্থানীয় মাস্তানরা পর্যন্ত লাভবান হচ্ছে। আর তা-ই ধীরেসুস্থে চলছে সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া।
যদি তা-ই হয়, এ দেশের সাধারণ মানুষই একদিন জাতিসংঘকে ‘আলী বাবা’ বলে সম্বোধন করা শুরু করবে। এ দেশের সচেতন মহল তা দেখতে চায় না।
লেখক : মেজর, পিএসসিজি (অব.), আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে কর্মরত।