দৃষ্টিপাত
সবুজায়নে পাগল কিছু মানুষের গল্প
সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পর্কে নানা ধরনের মুখোরোচক গল্প চালু আছে। বেশির ভাগই গল্প, তবে কিছু যে সত্যি কথা নেই তেমন কিন্তু বলা যাবে না। বেশির ভাগ গল্পের ভেতরে ওই সামান্য কিছু সত্য আবার সবকিছুকে ম্লান করে দেয় বৈকি! গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় অসততার কথা।
বহু লেখালেখির পরও দেখা যায় এক শ্রেণির মানুষ সবুজ ধংস করে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলছে, বনাঞ্চল কেটে সাফ করে দিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছে রাতারাতি, এর পাশাপাশি কিছু সরকারি কর্মকর্তা সবুজকে বাঁচিয়ে রাখতে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্বের বাইরে গিয়ে সামাজিক কাজ করে যাচ্ছে। আমরা কি তখন আশায় বুক বাঁধতে পারি না?
রংপুর জেলার তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিলুফা সুলতানা, তারাগঞ্জবাসীকে সবুজায়নে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর, তাঁর অনুপ্রেরণায় ভোরবেলা তারাগঞ্জের ২৩০ কিলোমিটার রাস্তায় বৃক্ষরোপণে মেতে উঠেছিল মানুষ। জিলুফা সুলতানাকে সহায়তা করেছিল এলাকার জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে অনেক সরকারি সংস্থা। দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি।
এ রকম আরেকজন হচ্ছেন, ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু জাফর রিপন। তিন লক্ষাধিক গাছ লাগিয়ে সবুজায়ন করেছিলেন ত্রিশালকে। কষ্টও কম করতে হয়নি তাঁকে এর জন্য। ছুটতে হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের কাছে, কখনো সভা করেছেন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তো ছিলই। ‘সবুজ ত্রিশাল’ আন্দোলনটি সফল করতে পেরেছিলেন এলাকাবাসীর সহায়তায়।
আরেকজন হচ্ছেন যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মনদীপ ঘরাই। এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি উপজেলায় তাল বিপ্লব শুরু করেছিলেন। আড়াই লাখ তালবীজ লাগিয়েছিলেন। তাঁকে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ সাহেব।
২০১৭ সালের ১৫ জুলাই, বরিশাল-ভোলা মহাসড়কে হিরন পয়েন্ট থেকে চরকাউয়া জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ৪-৮ কিলোমিটার রাস্তার দুপাশে কৃষ্ণচূড়া, সোনালু, জারুল গাছ লাগিয়েছিলেন বরিশালের সে সময়ের জেলা প্রশাসক গাজী মো. সাইফুজ্জামান। একটি সড়কের দুই পাশে এ ধরনের গাছ যখন বড় হবে তখন পরিবেশটা কি রকম সুন্দর মোহনীয় হয়ে উঠবে, ভাবলেই ভালো লাগে।
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম ‘সবুজ ও পরিচ্ছন্ন রাজারহাট গড়ি’ এই স্লোগানে এ বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষার্থী আর সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় সাত লাখ গাছের চারা রোপণ করেছিলেন। উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগ আর সাধারণ মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণই ছিল তাঁর স্বপ্নপূরণে সহায়ক।
এ বছরের ১৭ অক্টোবর। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসরাত সাদমীন ‘লাগাই তাল বৃক্ষ প্রেয়সী মির্জাপুরে/ বজ্রপাতে মরণভীতি হারিয়ে যাক চিরতরে’— এ রকম স্লোগান নিয়ে উপজেলায় চার লাখ তালগাছ ও তালবীজ রোপণ করার উদ্যোগ নেন। বজ্রপাত থেকে মানুষকে সচেতন করার জন্যই এ রকম উদ্যোগ নেন তিনি।
‘সবুজ চুয়াডাঙ্গা, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ এ স্লোগানে চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দিন আহমেদ তাঁর কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে জেলার সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতায় সাড়ে সাত লাখ ফলদ, বনজ, ঔষধি ও তালবীজ রোপণ করেছিলেন মাত্র এক ঘন্টায়। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ বিতরণ করা হয় জেলার শহর ও গ্রামাঞ্চেল মানুষ, স্কুল কলেজে ও মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের মাঝে।
এত সব ঘটনার খবর খুব বেশি পত্রপত্রিকায় আসেনি। এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর স্থানীয় দু-একটা অন লাইন পোর্টালে। আর সেখান থেকে জানা গেল, এভাবেই নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন আমাদের কিছু সরকারি কর্মকর্তা।
আমরা আশায় থাকলাম, আমাদের দেশের সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ব্যক্তি নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের বাইরে গিয়ে সমাজের সচেতন মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের প্রকৃতিকে রক্ষা করবে। আগামী প্রজন্ম এই ছায়া শীতল পরিবেশে বেড়ে উঠবে।
রাস্তার দুই ধারে সোনালু আর কৃষ্ণচূড়ার মাঝখান দিয়ে হেঁটে হেঁটে নতুন প্রজন্ম শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে রাখবে বরিশালের সেই জেলা প্রশাসক গাজী মো. সাইফুজ্জামানের নাম শুনে। চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দিন আহমেদের গাছ লাগানোর কথা শুনে, অভয়নগর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মনদীপ ঘরাই এর তাল বিপ্লব, তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিলুফা সুলতানার সবুজায়ন, ত্রিশাল উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু জাফর রিপন এর ‘সবুজ ত্রিশাল আন্দোলন’, রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম এর ‘সবুজ ও পরিচ্ছন্ন রাজারহাট গড়ি’, মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসরাত সাদমীনেরর ‘লাগাই তাল বৃক্ষ প্রেয়সী মির্জাপুরে/ বজ্রপাতে মরণভীতি হারিয়ে যাক চিরতরে’ এসব স্লোগানের কথা শুনে শ্রদ্ধা এমনিতেই চলে আসবে।
অভিনন্দন আপনাদের।
লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক।