এক্সট্রা কাভার
ক্রিকেটের বড় বিজ্ঞাপন হোক বাংলাদেশ
ক্রিকেটীয় সুসময় বললে বাড়তি আবেগের ছোঁয়া থাকবে তাতে। বরং বলা ভালো, রঙিন পোশাকে সুসময় পার করছে বাংলাদেশ ক্রিকেট। সত্যি বলতে এর চেয়ে ভালো সময় আর কবে পার করল বাংলাদেশ! বিশ্বকাপের আগে জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ। বিশ্বকাপ থেকে ইংল্যান্ডকে ছিটকে দিয়ে ক্রিকেট-বিশ্বকে ঝাঁকুনি দেওয়া। তার পর পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করা! ক্রিকেটীয় রিখটার স্কেলে মাপলে সেটা রীতিমতো ভূমিকম্প। সেই কম্পন থামতে না থামতে ভারতের বিপক্ষে সিরিজ জয়! এ রকম যমজ সাফল্য বাংলাদেশ আগে কখনো দেখেনি। কিন্তু তার পর যা দেখল, তাতে গোটা ক্রিকেট-বিশ্বের চোখ বড় হয়ে গেল! প্রায় খাদের কিনার থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জয়! ক্রিকেট-বিশ্ব এখন অপলক তাকিয়ে বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশকে এ রকম সাফল্যের জোয়ারে ভাসতে দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে এক যুগ আগে সাউথ আফ্রিকান এয়ারওয়েজের একটা বিজ্ঞাপনের কথা। ২০০৩ সালে নিজেদের মাঠে বিশ্বকাপের সময় দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন শহরে দেখা গেছে বড় বড় বিলবোর্ড, যাতে লেখা ছিল—‘প্রিয় পলি, আমরা ওদের এখানে নিয়ে এসেছি। এবার ওদের দেশে ফেরত পাঠানোর দায়িত্বটা তোমাদের।’ পলি মানে শন পোলক, দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক। আর ওই বিজ্ঞাপনী ভাষার মর্মার্থ হচ্ছে, সাউথ আফ্রিকান এয়ারওয়েজ বাকি দলগুলোকে বিশ্বকাপের জন্য সাউথ আফ্রিকায় এনেছে। তাদের একে একে দেশে ফেরত পাঠানোর দায়িত্ব পোলক, ডোনাল্ড, ক্যালিস, ক্লুজনার, বাউচারদের। বিজ্ঞাপনের ভাষা ধার করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা এখন বলতে পারেন—ম্যাশ, আমরা ওদের এনে দিয়েছি। তোমরা তোমাদের মতো করেই দেশে ফেরত পাঠাও। ওদের মানে শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা নয়, পাকিস্তান, ভারতও। পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করে করাচির বিমান ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতকে ২-১ ব্যবধানে হারিয়ে কলকাতার বিমানে ওঠানো হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার অনেকে ওয়ানডে সিরিজ ২-১ ব্যবধানে হেরে জোহানেসবার্গের বিমান ধরে দেশে চলে গেছেন। আবার কেউ কেউ ফিরতি বিমানে চট্টগ্রামে পৌঁছেছেন টেস্ট সিরিজের জন্য।
রঙিন পোশাক থেকে এবার সাদা পোশাকের বাংলাদেশ। সাদা পোশাক, লাল বলের নতুন চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের সামনে। আর এই চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশ এখনো ততটা উজ্জ্বলভাবে নিজেদের মেলে ধরতে পারেনি। সাদা পোশাকের বাংলাদেশকে নিয়ে করপোরেট জগতেও চাহিদা কম। তাদের নিয়ে কোনো বিজ্ঞাপন চিত্রও নেই! জনঅনুধাবন ক্ষমতার সঙ্গে বিজ্ঞাপন এজেন্সির এই জায়গাটায় দারুণ মিল! টেলিভিশনের পর্দায় ক্রিকেটারদের নিয়ে বিজ্ঞাপনের দাপাদাপি যা, তা তো সেই ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি ঘিরে। গ্যালারিতে দর্শকের নাচানাচি সেটাও সেই রঙিন পোশাকের মাশরাফি-সাকিব-সৌম্য-মুস্তাফিজদের নিয়ে! সাদা পোশাকে মুশফিকদের জ্বলে উঠতে হবে শুধু তাঁদের স্পন্সরদের বিজ্ঞাপনের ক্যাচ লাইনটা ধরে। আপন শক্তিতেই জ্বলে উঠতে হবে টেস্টে বাংলাদেশকে।
এবং এই জ্বলে উঠতে ব্যর্থ হলে বিজ্ঞাপনের অন্য ভাষা ব্যবহৃত হতে পারে। ক্রিকেটের বিশুদ্ধ রূপটা হচ্ছে টেস্ট। যেখানে রংচংয়ের চলন নেই। এখানে নিখুঁত টেকনিক আর শুদ্ধতম অভিব্যক্তি হচ্ছে শেষ কথা। এখানে সাফল্যের রসায়নটাও খুব সহজ। নিজের উন্নত স্কিল। কিছু করে দেখানোর উদগ্র ইচ্ছাশক্তি আর সংকল্প। এখানে কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড় দেয় না। আর এই টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখনো গদ্যের জগতের বাসিন্দা। তাদের নিয়ে কবিতা লেখার, কাব্য করার সময় এখনো আসেনি; বরং এখানে বাংলাদেশকে যাঁরা সফল দেখতে চান, তাঁরাও জানেন, টেস্টে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের এক একটা দিন পার করতে হবে ঠিক দিনমজুরের মতো। খেটেখুটে সাফল্য পেতে হবে। ওয়ানডে ক্রিকেট যদি এখন হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জীবনকে রাঙিয়ে দেওয়ার গল্প, তাহলে টেস্ট হচ্ছে সেই জীবন, যেখানে অনেক জ্বালা-যন্ত্রণা পোহাতে হয়। রক্তাক্ত অবস্থায় থেঁতলে যেতে যেতেও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে হয়। যেখানে সাফল্যটা হবে অনেক বেশি মানবিক, গৌরবময় এবং মর্যাদার।
দক্ষিণ আফ্রিকা বাংলাদেশকে সেই গৌরবের রাস্তায় উঠতে দিতে চাইবে না। প্রয়োজনে অনেক বেশি অমানবিক হতেও দ্বিধা করবেন না তাঁরা। আর এসব প্রেসক্রিপশনও বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের জানা। তার পরও একটা কথাই বলা, প্রয়োজনে মাঠে শ্রমিকের মতো পড়ে থাকুন। কুৎসিৎতম ক্রিকেট খেলুন। সেটাই এনে দিতে পারে টেস্টে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সর্বোত্তম দিনকে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে না হারাও বাংলাদেশ ক্রিকেটের বড় বিজ্ঞাপন হতে পারে। সে রকম একটা বিজ্ঞাপন দেখার অপেক্ষায় গোটা দেশ।
লেখক : সাংবাদিক