এক্সট্রা কাভার
কোথা থেকে শুরু হবে ক্রিকেটের শুদ্ধিকরণ
দুর্নীতির নাগপাশে জড়িয়ে গেছে ক্রিকেট নামক খেলাটা। এটা নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু খেলাটার সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা যারা, সেই আইসিসি বারবার ক্রিকেটকে শুদ্ধিকরণের কথা বলেছে। আইপিএল স্পট ফিক্সিং নিয়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণা হওয়ার পর আর একটা প্রশ্ন জোরালোভাবে উঠছে, শুদ্ধিকরণের শুরুটা হবে কোথা থেকে?
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি জগমোহন ডালমিয়া থেকে সচিব অনুরাগ ঠাকুর—সবাই বলছেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে সম্মান জানাতে হবে। ভালো কথা। সেই সম্মান না দেখিয়ে বিসিসিআইয়ের উপায়ও নেই। সুতরাং রায় অনুযায়ী চেন্নাই সুপার কিংস আর রাজস্থান রয়্যালস দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধই হচ্ছে। আর আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ চেন্নাই সুপার কিংসের মায়াপ্পন আর রাজস্থান রয়্যালসের কুন্দ্রার। দুটো ফ্র্যাঞ্চাইজি নিষিদ্ধ মানে আগামীতে ছয় দল নিয়ে হবে আইপিএল। যে কারণে সুনীল গাভাস্কারের মতো লোকও বলছেন, ‘ধোনিকে আইপিএলে দেখা যাবে না! খারাপ লাগছে।’ তারকা ধোনি, ক্রিকেটার ধোনির ভক্তদের জন্য খারাপ খবর। কিন্তু তাঁর দলটা যে ম্যাচ গড়াপেটায় জড়িত ছিল, তা নিয়ে সন্দেহের আর কোনো কারণ নেই। তার পরও প্রশ্ন হচ্ছে, ঘটনাচক্রে ধোনির মতো ক্রিকেটাররা নির্বাসিত হয়ে গেলেন আইপিএল থেকে! কিন্তু কাদের জন্য? চেন্নাই সুপার কিংস দলটার মালিকানা কাদের? ইন্ডিয়ান সিমেন্টের। আর এই ইন্ডিয়ান সিমেন্টের হর্তাকর্তা সবই তো নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন। এন শ্রীনিবাসন সেই ব্যক্তি, যিনি একসময় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। যিনি এ মুহূর্তে আইসিসি নামক ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থার চেয়ারম্যান। স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারির পর থেকে আইপিএলকে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ না বলে মিডিয়ায় পর্যন্ত বলা হয়েছে, ‘ইন্ডিয়ান প্রবলেম লিগ’! সেই আইপিএল কেলেঙ্কারিতে যে চেন্নাই সুপার কিংস নিষিদ্ধ হলো, তার মালিকানার সঙ্গে জড়িয়ে এন শ্রীনিবাসন। যাঁর জামাতা আইপিএল স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে আজীবন নিষিদ্ধ হলো, সেই লোকটা কি আইসিসি নামক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার কোনো নৈতিক অধিকার রাখেন? অবশ্য নীতি-নৈতিকতা বলে শব্দ-টব্দ এন শ্রীনিবাসনের অভিধানে আছে বলে মনে হয় না। ভদ্রলোক ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি পদে থাকার জন্য ওসবকে তো আগেই বির্সজন দিয়েছিলেন। তারপর লজ্জা-টজ্জা বলে যদি কিছু থাকত, তাও তো গত মার্চে মেলবোর্নের ইয়ারা নদীতে বিসর্জন দিয়ে বিশ্বকাপ ট্রফি দিতে মঞ্চে উঠে যান আইসিসির সে সময়ের সভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামালকে ছিটকে দিয়ে! সেই লোকটার কাছ থেকে নীতি-নৈতিকতা, লাজ-লজ্জা এসব আশা করা ঠিক হবে না। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডে আরো তো কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা অন্তত ক্রিকেটের শরীর থেকে শেষ অন্তর্বাসটুকু খুলে ফেলতে চাইবেন না। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী যদি শ্রীনিবাসনের চেন্নাই সুপার কিংস নিষিদ্ধ হয়, শ্রীনির জামাতা গুরুনাথ মায়াপ্পন যদি ক্রিকেটেই আজীবন নিষিদ্ধ হন এবং তাঁর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে যদি আদালত থেকে বলা হয়, এরা শুধু আইপিএল নয়, বিসিসিআইসি নয়, গোটা ক্রিকেটের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে—তাহলে ক্রিকেটের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য আইসিসির মতো একটা সংস্থায় কীভাবে চেয়ারম্যানের পদে বসে থাকেন এন শ্রীনিবাসন!
অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, শ্রীনিবাসন তো আর নিষিদ্ধ হননি। হয়তো তাই। কিন্তু নিষিদ্ধ হতে বাকি কী রইল! তাঁর চেন্নাই সুপার কিংস যখন নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তাঁর জামাতা যখন আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যান, তখন এন শ্রীনিবাসন নামক লোকটা যদি আইসিসির চেয়ারম্যানের পদে বসে থাকেন, তাহলে খেলাটার হারানো বিশ্বাসযোগ্যতা আর ফিরে আসতে পারে না। ক্রিকেট তার বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পাক, স্পট ফিক্সিং, ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ভাইরাস মুক্ত হোক ক্রিকেট—এটা ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড চায় কি না, সেটা দেখার সময় এসেছে। সত্যিই যদি ভারতীয় ক্রিকেটকর্তারা ক্রিকেটের শুদ্ধিকরণ চান, তাহলে এন শ্রীনিবাসনের মতো লোককে আইসিসিতে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে রাখবেন কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। সেপ্টেম্বরে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সাধারণ সভা। সেখানে শ্রীনিবাসন প্রসঙ্গ তোলার লোকের অভাব হবে না। কিন্তু সিদ্ধান্তটা কী আসে, সেটা দেখার জন্য কৌতূহল নিয়ে মুখিয়ে ক্রিকেট-বিশ্ব।
অবশ্য তারও আগে দেখার বিষয়, ক্রিকেটের শুদ্ধিকরণ আইসিসির ভেতর থেকে শুরু হয় কি না।
লেখক : সাংবাদিক