প্রতিক্রিয়া
সিদ্দিক ও জালালের চোখ এবং দায়মুক্তি
রাজধানীর শাহবাগে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে দৃষ্টি হারানো তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমানের একটি চোখ নিয়ে কিছুটা আশার আলো জ্বলেছে। চিকিৎসক বলছেন, তাঁর একটি চোখ নিয়ে আপাতত কোনো আশা না থাকলেও অন্যটি হয়তো দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে। তারপরও আশার খবর, সিদ্দিকের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে সরকার এবং এরই মধ্যে তাঁকে ভারতের চেন্নাইয়ে পাঠানো হয়েছে। আর পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, সিদ্দিকুর রহমানের চোখ হারানোর ঘটনায় পুলিশের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
২০ জুলাই রাজধানীর শাহবাগের এ ঘটনার দুদিন আগে, ১৮ জুলাই রাতে খুলনা শহরে শাহজালাল নামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর দুটি চোখ তুলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী শাহজালালের দাবি, তাঁকে শ্বশুরবাড়ির সামনে থেকে আটক করে থানায় নিয়ে টাকা দাবি করে পুলিশ। টাকা দিতে না পারায় খুলনার বিশ্বরোড এলাকায় নিয়ে হাত-পা ও মুখ বেঁধে তাঁর দুই চোখ তুলে ফেলা হয়। যদিও পুলিশের দাবি, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়লে জনগণ শাহজালালকে মারধর করেছে। তবে কে বা কারা তাঁর চোখ তুলে নিয়েছে, সে বিষয়ে পুলিশ কিছু বলেনি। শাহজালালের চিকিৎসার দায়িত্ব সরকার নেয়নি। তাঁর চোখের বীভৎসতা দেখতেও যাননি কোনো মন্ত্রী। কেননা, শাহজালাল কথিত ছিনতাইকারী। ছিনতাইকারী হলে তাঁর চোখ উপড়ে ফেলা জায়েজ।
আমরা স্মরণ করতে পারি, রাজধানীর অদূরে সাভারে শামীম শিকদার নামের এক অটোরিকশা চালকের কথা, যিনি ট্রাফিক পুলিশের আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়েছেন এবং এখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ঢাকা মেডিকেলের বিছানায়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২৯ জুন সকালে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালাতে গিয়ে পুলিশের কাছে অপমানিত ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর ক্ষোভ থেকে শামীম নিজের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান।
গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর গুদারাঘাট বাবুল নামের এক চায়ের দোকানি আগুনে পুড়ে মারা যান। এ ঘটনায়ও অভিযোগে তীর ওই পুলিশের দিকে। স্বজনদের অভিযোগ, চাঁদা না পেয়ে পুলিশ বাবুলের দোকানের কেরোসিনের চুলায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে। এতে কেরোসিন ছিটকে গায়ে আগুন ধরে যায়। শুধু তাই নয়, ঘটনার পর পুলিশ অগ্নিদগ্ধ বাবুলকে হাসপাতালের বদলে থানায় নিয়েছিল বলেও অভিযোগ তাঁদের। কিন্তু পুলিশের বিরুদ্ধে যখনই এ রকম অভিযাগ ওঠে, যথারীতি তার তদন্ত হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা ‘সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধ’ কিংবা ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থ’ বিবেচনায় দায়মুক্তি পান।
একদিকে সংবিধান বলছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী (অনুচ্ছেদ ২৭), অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়মুক্তির ক্ষমতা। ৪৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ যদি কোনো অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে কোনো কাজ করে, তবে তাকে আইনের মাধ্যমে দায়মুক্ত করা যাবে। অর্থাৎ শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যদি কাউকে হত্যাও করা হয়, তবু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অব্যাহতি দিয়ে আইন প্রণয়ন করা যাবে। তার মানে আইনের দৃষ্টিতে কেউ কেউ বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন এবং এটি সংবিধানস্বীকৃত।
সংবিধান বলছে, মৌলিক অধিকার-পরিপন্থী কোনো আইন করা যাবে না। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে কাউকে খুন করা, কারো চোখ তুলে ফেলা স্পষ্টত মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের পরিপন্থী হলেও এসব অপরাধে খুব কমই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় র্যাব সদস্যদের বিচার হলেও ঝালকাঠির কলেজছাত্র লিমনকে পঙ্গু করে দেওয়া কিংবা এ রকম আরো অনেক নিরপরাধ মানুষকে খুন, গুলি অথবা গুম করে দেওয়ার ঘটনায় কারো বিচার হয়েছে—এমন উদাহরণ নেই।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত চলে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’। ওই সময় নিহত হওয়া প্রসঙ্গে অভিযান পরিচালনাকারীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, সবাই হৃদেরাগে মারা গেছেন। অভিযানের কার্যক্রমকে দায়মুক্তি দিয়ে ২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি’ আইন করা হয়। যদিও পরে উচ্চ আদালত এই আইনকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন।
দায়মুক্তির আরো কিছু উদাহরণ দেওয়া যায়। যেমন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনার জন্য প্রণীত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আইন, ২০১৫-এ বিধান রয়েছে, ‘এই আইন প্রবর্তনের পূর্বে বা সময় বা পরবর্তীতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনার বিষয়ে সরল বিশ্বাসে কৃত কোন কাজকর্মের জন্য সরকার, চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রকল্প পরিচালক, অন্য কোন পরিচালক, পরামর্শক, উপদেষ্টা, কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোন দেওয়ানী বা ফৌজদারী মামলা বা অন্য কোন আইনগত কার্যক্রম গ্রহণ করা যাইবে না।’
নাগরিকের তথ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে প্রণীত তথ্য অধিকার আইন, যেটিকে বলা হচ্ছে দেশের অন্যতম সেরা ও গণতান্ত্রিক আইন— সেখানেও এই দায়মুক্তির বিধান রয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, ‘এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি বা প্রবিধানের অধীন সরল বিশ্বাসে তথ্য প্রকাশ করা হইয়াছে বা করিবার উদ্দেশ্য ছিল বলিয়া বিবেচিত, কোন কার্যের জন্য কোন ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হইলে তিনি তথ্য কমিশন, প্রধান তথ্য কমিশনার, তথ্য কমিশনারগণ বা তথ্য কমিশনের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী, বা কর্তৃপক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা অন্য কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোন দেওয়ানী বা ফৌজদারী মামলা বা অন্য কোন আইনগত কার্যধারা রুজু করা যাইবে না।’
শাহবাগে যেদিন শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের লাঠিপেটা ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করল, যেদিন সিদ্দিকুরের চোখ নষ্ট হয়ে গেল, তার ব্যাখ্যায়ও পুলিশ বলেছে, নাগরিক দুর্ভোগ এড়াতে শিক্ষার্থীদের শাহবাগ এলাকা থেকে সরে যেতে বলার পরও তঅঁরা সরে না যাওয়ায় এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ওই যে সংবিধানে বলা আছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, সেই দোহাই দিয়ে পুলিশ বরাবরের মতোই হয়তো পার পেয়ে যাবে।
যদিও ঘটনার ভিডিওর উদ্ধৃতি দিয়ে খবরে বলা হয়েছে, ‘খুব কাছ থেকে ছাত্রদের টার্গেট করে কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। সে সময়ই সিদ্দিক মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।’ সিদ্দিকুর রহমানের বন্ধু ও সহপাঠীরা বলেন, ‘ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, পাঁচ হাতের কম দূরত্ব থেকে পুলিশ টার্গেট করে কাঁদানে গ্যাস ছুড়ছে। তাহলে এখন কি আমরা সিদ্দিকের ওপর হামলার জন্য পুলিশের বিচার চাইতে পারি না?’ সিদ্দিকুরের সহপাঠী ফরিদউদ্দিন বলেন, ‘যখন ছাত্রদের অযথাই ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন সিদ্দিকুর একজনকে উদ্ধারে এগিয়ে যান। এরপর তাঁর চোখ লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়।’
পুলিশ মহাপরিদর্শকের ভাষ্য, পুলিশের মতো একটি বড় বাহিনীর ভেতর কিছু কিছু সদস্য আছে, যারা অতি উৎসাহী। যদি অতি উৎসাহিত হয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে এবং তদন্ত কমিটি এর প্রমাণ পায়, তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সম্প্রতি বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা এবং বর্তমানে বরগুনা সদর উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত তারিক সালমনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির অভিযোগে বরিশালের এক আওয়ামী লীগ নেতা ও আইনজীবীর মামলাকেও দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অতি উৎসাহীদের কর্মকাণ্ড। অর্থাৎ যখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তখন এই অতি উৎসাহের ব্যাপারটি আমাদের সামনে হাজির করা হয়। কিন্তু আমাদের সিস্টেমেই যে প্রবলেম রয়ে গেছে, অতি উৎসাহীরাও যে সেই সিস্টেমের বাইরের কেউ নন, তাঁরা যে অন্যগ্রহ থেকে আসেননি, সেটিও মনে রাখা দরকার।
তবে এও ঠিক, যে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়, যেখান প্রতিদিনই সড়কে মৃত্যুর মহামারীতে অসংখ্য পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়, যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়ার পর আর কোনো খোঁজই মেলে না, সেখানে দুজন মানুষের চোখ তুলে ফেলা বা নষ্ট করে দেওয়া নিশ্চয়ই বড় কোনো ঘটনা নয়।
লেখক : সাংবাদিক।