অভিমত
উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ কে করবে?
গোপালগঞ্জে বাড়ির সামনে মেয়েকে উত্ত্যক্তের সময় প্রতিবাদ করায় বখাটেরা তার বাবাকে ছুরিকাহত করে। ৯ দিন চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় গত রোববার গভীর রাতে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। (প্রথম আলো, ২৫ জুলাই ২০১৭) এদিকে মাদারীপুরে বখাটের ব্লেডের আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে সপ্তম শ্রেণির এক মাদ্রাসাছাত্রী।(খোলাকাগজ, ২৬ জুলাই ২০১৭) এই সংবাদ সংবাদপত্রের প্রথম কিংবা শেষ পাতার প্রতিদিনের আলোচিত বিষয়। থেমেও নেই এসব উত্ত্যক্তকরণ কিংবা উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় বখাটেদের হাতে মারধরের শিকার।
লেখাটা শুরুর আগে গোপালগঞ্জের ঘটনা পড়ে মনে হচ্ছিল কবে বন্ধ হবে এসব? নাটোরের গুরুদাসপুরে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর বাবাকে পিটিয়ে আহত করে বখাটেরা।(মানবকণ্ঠ, ২৮ মে ২০১৭)। এ ছাড়া নাটোরের গুরুদাসপুরে ছাত্রী উত্ত্যক্তকারীদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করায় ছাত্রীর বাবাসহ চারজনকে কুপিয়ে জখম করে উত্ত্যক্তকারী ও তার স্বজনরা।(প্রথম আলো, ৩০ মে ২০১৭)
মেয়েরা নিজেরাই প্রতিবাদ করেছে এমন গল্পও আছে। ঝালকাঠিতে তিন কিশোরী রাস্তায় ফেলে পিটিয়েছে এক বখাটেকে। বখাটে ক্রমাগত উত্ত্যক্ত করে আসছিল তাদের। ঝালকাঠীর ওই মেয়েরা সাহস করে, নিজেরাই সমাধান করতে চেয়েছে তাদের সমস্যার। (প্রথম আলো, ২৩ জুন ২০১৭)।কিন্তু সে ঘটনা আমাদের আশান্বিত করলেও, বন্ধ হয়নি উত্ত্যক্তের মতো ঘৃণ্য আচরণ। তাই কয়েকটি প্রতিরোধের গল্প শুনে বা পড়ে সন্তুষ্ট থাকতে নারাজ আমি। কারণ থেমে নেই বাবার সামনে মেয়েকে উত্ত্যক্তকরণ কিংবা বোনকে ভাইয়ের সামনে উত্ত্যক্তকরণ। আর সে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করলেই হতে হচ্ছে বলির পাঠা। কখনো বড় ভাই আবার কখনো বাবাও। তাহলে কতটা হিংস্র এই মানসিক বিকারগ্রস্ত বখাটেরা। কিন্তু, কতদিন? একসময় বোনকে উত্ত্যক্ত হতে দেখলেও ভাই এগিয়ে আসবে না। মেয়ে উত্ত্যক্ত হলেও বাবা এগিয়ে আসবে না প্রতিরোধ কিংবা প্রতিবাদ করতে। কারণ করলেই তো পঙ্গুত্বের শিকার কিংবা মৃত্যুর মুখে পতিত হতে হবে। তাহলে উত্ত্যক্তকরণের প্রতিবাদ করবে কে?
এবার আসল কথায় আসি যে দেশে ঘটা করে রোকেয়া দিবস, আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। সেই দেশে এখনো আমার বোন কিংবা মেয়েকে রাস্তায় বখাটেদের ঘৃণ্য চোখে আর তিক্ত বাণে উত্ত্যক্তের শিকার হতে হয়। তাহলে এই রোকেয়া দিবস, আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের মাহাত্ম্য কোথায়? আর যে প্রতিবাদের কথা বলছি, সে প্রতিরোধও এখন নিজ নিজ ব্যথা থেকে করছে মানুষ। কেননা যখন একজন মেয়ে শ্লীলতাহানি কিংবা উত্ত্যক্তকরণের শিকার হচ্ছে তখন সে ব্যাথাটা ওই মেয়েটির পরিবারের স্বজনদের। আপনার আমার না! সেটাই তো দেখছি না হলে খবরের পাতায় কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় দেখতাম মেয়েকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় ভাইকে পেটাল উত্ত্যক্তকারী বখাটেরা ও বাবাকে ছুরিকাহত করল বখাটে সন্ত্রাসীরা। আর কতদিন? শুধু নিজের পিঠকে বাঁচানোর চেষ্টা থেকে সরে আসুন। যদি সরে না আসেন তাহলে সেদিন আর বেশি দূরে নেই যখন আপনার সামনে আপনার স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করবে। তখন আপনি প্রতিরোধ করলে আপনাকেও একই নির্মম পরিণতির শিকার হতে হবে। তাহলে ভাই, চাচা এখনই এগিয়ে আসুন না। আপনার প্রতিবেশী ভাইয়ের মেয়েকে উত্ত্যক্তকরণের সময়। কিংবা অপরিচিত কোনো মেয়েকে নির্যাতনের শিকার হতে দেখে। তবেই তো বন্ধ হবে এসব উত্ত্যক্তকরণের নামে নির্যাতন। বখাটেরাও বুঝে যাবে, উত্ত্যক্ত করলেই গণধোলাই খেতে হবে। আর যদি সম্মিলিতভাবে এগিয়ে না আসেন তবে, বখাটেরা পৈশাচিক আনন্দের সঙ্গে উত্ত্যক্তকরণ করেই যাবে। শুধু কি সরাসরি উত্ত্যক্তকরণের প্রতিবাদ করলে নির্যাতনের শিকার হতে হয? না। আমরা দেখেছি নাটোরের গুরুদাসপুরে উত্ত্যক্তকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করায় বাসায় ঢুকে ছাত্রীর বাবাসহ চারজনকে কুপিয়ে জখম করে উত্ত্যক্তকারী ও তার স্বজনরা। তাহলে বুঝুন ভাই। তাদের প্রতিরোধ করা আপনার আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ এই বখাটেরা আজ সমাজে, রাষ্ট্রে সংঘবদ্ধ। যতটা সংঘবদ্ধ নয় আমাদের চারপাশের বসবাসরত প্রতিবেশীরা। তাহলে সে সুযোগকে কাজে লাগাবেই বখাটে সন্ত্রাসীরা। কারণ তারা নিশ্চিত যে, আফজালের (প্রতীকি নাম) মেয়েকে কিংবা বোনকে উত্ত্যক্ত করলে আনোয়ার (প্রতীকি নাম) আসবে না। তাহলে যখন আনোয়ার যাবে না তার প্রতিবেশী আফজালের মেয়েকে উত্ত্যক্তকরণের প্রতিবাদ করতে। ঠিক তখনই বখাটেরা সমাজ রাষ্ট্রে এই উত্ত্যক্তকরণের নেশায় দিনদিন উন্মত্ত হয়ে উঠবে। কারণ এই বখাটেদের কোনো বোন কিংবা মেয়ে নেই। আছে শুধু উত্ত্যক্তকরণের উন্মত্ততা। আর সেখানে বোন কিংবা মেয়ের চিন্তায় আসার কথাও নয়।
আবার অনেক সময় দেখি, অনেকেই আছেন যারা প্রতিবেশী কিংবা অপরিচিত কোনো মেয়েকে উত্ত্যক্ত করেছে সেখানে প্রতিবাদ করে। কিন্তু তার মাত্রাটাও যৎসামান্য। এই প্রতিরোধের মাত্রাকে বাড়াতে প্রয়োজন নিজের পিঠ বাঁচানোর ফন্দি থেকে ফিরে আসা। কারণ চলতে ফিরতে আশপাশের অনেক পরিস্থিতি দেখি। যেখানে একই পাড়ার একজন মেয়ে উত্ত্যক্ত হলে অন্যজন বলে, সমস্যাটা তো আমার না। ভাই দিব্যি করে বলছি, ওই মেয়েটা কিংবা বোনটা আপনার না ঠিক। কিন্তু এই ভেবে এই উত্ত্যক্তকরণ ব্যাধির আক্রমণ থেকে রেহাই পাবেন না আপনি। রেহাই পেতে হলে ওই মেয়ে কিংবা বোনটিকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদে বখাটেদের বিরুদ্ধে আরো পাঁচ-দশজনকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে আসুন। তবে বখাটেরা সজাগ হবে। কারণ তাদের আস্ফালন দিনদিন ফুরিয়ে আসবে আমার আপনার প্রতিরোধের মুখে। কারণ বখাটেদের প্রতিরোধে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। অতএব আসুন সোচ্চার হই। নিজের বোনের কিংবা মেয়ের উত্ত্যক্তকরণের প্রতিবাদ করার হীন মানসিকতা পরিহার করি। প্রতিবেশী কোনো ভাইয়ের বোন কিংবা মেয়েকে উত্ত্যক্তকরণের সময়ও নিজের বোন-মেয়ে ভেবে এগিয়ে আসি। তবে এই উত্ত্যক্তকরণের ব্যাধি নির্মূল সম্ভব। আসুন সমস্যা আমার না, প্রতিরোধ না করলেও চলবে এই চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসি।
কারণ প্রতিবাদহীন থাকার ফল কোনো সময়ই ভালো হয় না। বখাটেরা আরো বেশি সংঘদ্ধ হয়ে ওঠে। কখনো উত্ত্যক্তকরণের মতো ঘটনা ঘটলেও প্রশাসনের ভূমিকা সবসময়, সব জায়গায় সক্রিয় থাকে না। বখাটেরা প্রভাবশালী হলে তো কথাই নেই। আর নিপীড়িত যদি হয় নিম্নবিত্ত শ্রেণির, তাহলে তার চিত্রটাও কি হয় আমরা অবগত। বিচার পাওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়। একসময় আপস মীমাংসা করতে হয় নিপীড়িত মেয়েটির পরিবারকে।
এজন্য সচেতন হতে হবে আমাদের মেয়ে-বোনদের। পাশাপাশি হতে হবে প্রতিবাদী। সচেষ্ট হতে বখাটেদের শুরুতেই রুখে দিতে। সত্যি বলছি, রাস্তায় যখন আপনি হেনস্তার শিকার হন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চুপ করে, গায়ে না লাগিয়ে, শুনতে পাননি এমন ভঙ্গিতে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করবেন না। এর ফলে উত্ত্যক্তকারীরা অন্য মেয়েদের সঙ্গেও একই রকম আচরণ করবে। আপনারা যদি একে একে ঝালকাঠির তিন কিশোরীর মতো বখাটেদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। দেখবেন আর সাহস পাবে না এসব বখাটে সন্ত্রাসীরা। সবসময় উত্ত্যক্তকারীরা যদি বাধা পায়, তাহলে এসব করার দুঃসাহস হবে না সমাজের শত্রু বখাটেদের।
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়