মানুষ কি উটপাখি হবে
১.
স্কুলে যাওয়া, অফিস-আদালত-কারখানায় যাওয়া-আসা করা মানুষের ছকবদ্ধ জীবনের অংশ। সাম্যবাদী সমাজ না আসা পর্যন্ত মানুষকে এগুলো করতে হবেই। কিন্তু হাঁটতে যাওয়া, রোদ পোহানো, আড্ডা দেওয়া, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সময় ও সুবিধার ওপর নির্ভরশীল। বিনোদনমূলক ঘটনা তো বাইরেই সংগঠিত হয়, তাই বাইরের পরিবেশের ওপর এগুলো নির্ভরশীল। সেই পরিবেশ যদি উপযুক্ত না হয়, তাহলে নিতান্ত বাধ্য না হলে মানুষ সেখানে থাকে না।
খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রতিকূল পরিবেশের প্রতি মানুষের অনাগ্রহ থাকে আর অনুকূল হলে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে মানুষ নানা কাজে আপনা থেকে অংশগ্রহণ করে। আর সেখান থেকে সংগঠিত হয় তাহরীর স্কোয়ার বা শাহবাগ। অর্থাৎ মানুষ যত বাইরে থাকে, সম্পর্ক তত মজবুত হয়।
ইয়ান গেল নামের একজন ডেনিশ স্থাপত্য শিল্পীর একটি ধ্রুপদী মর্যাদা পাওয়া গ্রন্থের নাম ‘লাইফ বিটুইন বিল্ডিংস’। তিনি দেখিয়েছেন স্থাপত্যকলা কীভাবে জনগণের হয়ে ওঠে। তাঁর কথা স্মরণ নিলাম এ জন্য যে, জীবন ও স্থাপত্যের মধ্যে যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন- সহাবস্থানের মাধ্যমে যোগাযোগের সূচনা কীভাবে করতে হয়। স্থান ভেদে যোগাযোগের সম্ভাবনা, পূর্বপরিচয় রক্ষার সুযোগ, সামাজিক পরিবেশগত তথ্য, অনুপ্রেরণার উৎস, উৎসাহব্যঞ্জক অভিজ্ঞতা, কার্যকলাপের মাধ্যমে আকর্ষণ যেমন খেলাধুলা ও বিভিন্ন কার্যকলাপের অভ্যাস, কার্যকলাপ ও বসার অধিকার, পথচারীদের চলাচলে আকর্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে নাগরিকদের সম্পর্ক নির্মাণ হয়।
তিনি অবকাঠামোর প্রভাবে পাঁচভাবে যোগাযোগের সম্ভাবনা বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে। দেখা ও শোনার ক্ষেত্রে ১. দেয়াল ২. অধিক দূরত্ব, ৩. উচ্চগতি, ৪. বহুতল ও ৫. বিপরীতমুখিতা; যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে। অর্থাৎ এই পাঁচটি শর্তের বিপরীত অবস্থাই যোগাযোগ নির্মাণ করে। শেষ কথা হলো, কিছু ঘটার পরিবেশ থাকলেই কিছু ঘটবে।
২.
একটি শহরে বাড়ি ও সার্বজনীন জায়গা যেমন পার্ক, চত্বর ও রাস্তার মাঝামাঝি কিছু একটা জায়গা থাকতে হয়। যেমন পাড়া বা মহল্লাভিত্তিক মাঠ, যেগুলো ওই পাড়ার এজমালি সম্পত্তি মনে করা হয়। এই মাঠ বা পাড়াগুলো থাকলে যে যোগাযোগ তৈরি হবে, তাতে অপহরণ কিংবা গুমের মত ঘটনাগুলো সহজে ঘটতে পারবে না। প্রত্যেকে প্রত্যেককে পাহাড়া দেয় সেখানে। সংসদ ভবন, ছবির হাট থেকে শুরু করে রংপুর শহরের পায়রা চত্বর গ্রীল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে , নিষিদ্ধ হয়েছে আড্ডা ও বাদ-প্রতিবাদের সমাবেশ। আর রংপুরের টাউন হল চত্বরের মত সারা দেশের চত্বরগুলো বাণিজ্যিক মেলার দখলে চলে গেছে, এমনকি প্রেসক্লাবের মত জায়গাগুলোতেও সমাবেশ নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। অথচ কিছুদিন আগেও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও বা-প্রতিবাদের জন্য মানুষ সমবেত হত। অপরিচিতজনরাও আস্তে আস্তে পরিচিতজন হয়ে উঠেন। পৃথিবীর শহরগুলো গড়েই উঠেছে পাবলিক প্লেসকে কেন্দ্রে রেখে। কারণ যেখানে মানুষের উপস্থিতি সেখানেই মানুষ থাকতে চায় -মানুষ মিলবে মানুষেরই সাথে!
বছর সাতেক আগেও দেখেছি, রংপুর শহরের মানুষ দেখা সাক্ষাতের জন্য টাউনহল কিংবা পায়রা চত্বর কিংবা লালবাগের কথা বলতেন। আর কুড়িগ্রামের মত গ্রামশহরে কলেজ মোড়ের কোনও চায়ের দোকানের ঠিকানা দেয়া হত, -এটা ছিল বড় শহর ও গ্রামীণ শহরের ভেদ। ইদানিং ঢাকা শহরেও শপিং মলের ঠিকানা দেয়া হয়। অর্থাৎ সামাজিক মানুষ হাঁটুরে বা বাজারি হয়ে উঠছে!
আজকের বাংলাদেশে শহুরে মানুষ বাড়ি থেকে সরাসরি কর্মক্ষেত্রে গিয়ে পড়ছে, মাঝখানে পাড়ার মাঠটি হারিয়ে গেছে, সড়ক আড্ডাও নেই। ফলে সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি হাওয়া, দাঁড়াবার ও বসার জায়গা নেই, নেই মানুষ ওঠার প্রক্রিয়া। এখান থেকেই জন্ম নেয় ভাড়াটে খুনি। এই বিচ্ছিন্ন মানুষ তো অন্ধ হবে দুর্বল হবে, হবে নত মানুষ; যে বিপ্লবী হবে না হবে অন্য কিছু।
৩.
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাজও বৈশিষ্ট্য জনগণকে ঘরের বাইরে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজে বেশি বেশি করে যুক্ত রাখা। কিন্তু শামসুর রাহমানের উদ্ভট উটের পীঠে চলেছে আমাদের স্বদেশ ও শহরগুলো। রাষ্ট্রের কর্তারা চান, পয়লা বৈশাখ ও রথযাত্রা থামুক, উৎসব সংক্ষিপ্ত করে ঘরে ফিরুক -সুবোধ তুই পালিয়ে যা!
একই কর্তাদের হুকুমে শহরগুলোও সেভাবেই গড়ে উঠছে -জনগণ বাড়ি নামক খোঁয়াড়ে ঢুকুক লোডশেডিং মেনে। সামাজিক মানুষ অধঃপতিত হোক প্রাণিমানুষে, যেখানে সে উটপাখি হবে।
লেখক : প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।