বন্ধু , করুন ফেসবুকীয় সাহায্য!
ব্যক্তিগতভাবে আমি ভীষণ আবেগি একজন মানুষ। আবেগের উদাহরণ দিতে বলেন যদি তো বলব, সিনেমা বা নাটক দেখেও আমি ভ্যা ভ্যা করে কাঁদি। রাস্তার ফুটপথ ধরে কোনো মা হয়তো তার সন্তানকে কোলে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে খুব সাধারণ এই দৃশ্য দেখেও আমি অনেক সময় ভেউ ভেউ করে কাঁদি। ফেসবুকে সময় কাটাতে এসেও ভেউ ভেউ করে কত যে কাঁদি। কারণে অকারণে কান্নার এই হিড়িক দেখে আমার আশপাশের মানুষজন এখন আর তাই আমার কান্নাকে পাত্তা দেয় না।
আমি মধ্যবিত্ত মানুষ। সুখী মানুষ। নিজের ইচ্ছেই চলি। প্রয়োজন অনুযায়ী আয়-রোজগার করি। একেবারেই ইচ্ছেমতো চলি। নিজের চলে যাওয়ার পর যে টাকা থাকে, তা উড়িয়ে দিতে আমার বিকল্প দুটি খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে। সে আমি জানি, তবু সুখে দিন কাটে আমার। এই ঢাকা শহরে আমার নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। অন্যের বাড়িতে ভাড়া থাকি। ভাড়া দিতে না পারলে চলে যেতে হবে জানি তবু মাথা গোঁজার ঠাই তৈরি করতে হিসাবি হতে পারি না।
ধরুন রিকশায় চড়লাম। ভাড়া না মিটিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে একখানা ভাব নিয়ে বলি। ভাড়া কত দেব।
দেন।
না বলেন কত?
ইনসাফ কইরা দেন আরকি!
আরে মিয়া রিকশা ভাড়া কত আমি জানি নাকি?
আইচ্ছা দেন ৫০ টাকা।
আমি ভাব দেখিয়ে ১০০ টাকা দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে আসি।
সে কি ভাব! সেকি গৌরব আমার। তাই বললাম আর কি! আমার দোসর পাওয়া কঠিন। তো সেই আমার একি বিপদ! বলেন দেখি।
ঈদে আমি ব্যাগ ভরে বাজার করে নিয়ে যাই আমার গ্রামের বাড়ির সবার জন্য। আশপাশের বাড়ির বড়-ছোটরাও তাতে বাদ পড়ে না। সে এক আলাদা সুখের সময়। আমার কাছে তাই ঈদ মানে ঈদ। ছোট-বড় সবার ইচ্ছে পূরণ করে দেওয়া। অলিখিত এই নিয়মে অভ্যস্ত আমি। অনেকগুলো কচি কচি ছোট্ট মুখও তাই অনায়াসে নির্ভর করে আমার ওপর। এক অপার খুশিতে প্রতিবার তাই আমার ঈদ আসে উজ্জ্বল আলোর ঝলকানিতে।
গত কয়েক বছর সে মাত্রা নষ্ট হতে বসেছে। এবার তো মনে হচ্ছে মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। সামর্থ্যের গলায় গামছা পেঁচিয়ে মারতে ইচ্ছে করছে আমারই। হতাশা তাই ধরে বসছে। আবেগে নয়, এবার কাঁদছি ব্যর্থতায়।
সামাজিক মাধ্যমের সংজ্ঞা কী, তা আমার জানা নেই। ফেসবুককে কেন সামাজিক মাধ্যম বলা হয় তাও জানি না। আমি একটাকে বলি বন্ধুবাজি! অন্তত যান্ত্রিক এই সময়ে এসে বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটানোর, মন খুলে কথা বলার কিছুটা অনুভূতি আমি এখানে পাই। সময়ে-অসময়ে তাই ঘুরি আমিও ফেসবুকে। সেই সুখের ফেসবুক এখন আমার হতাশার নাম।
ফেসবুকে সেবা, মানুষ মানুষের জন্য, আসুন পাশে দাঁড়াই, আসুন ইফতারিতে ক্ষুধার্তদের নিয়ে বসি, চলুন ঈদের আনন্দ ভাগ করি, চলুন বাচ্চাদের জন্য নেইল পলিশ কিনি, চলুন একটু দামি শাড়ি গিফট করে গরিবদের চমকে দিই, চলুন পাশে দাঁড়াই বস্তিবাসীর... তরুণদের এসব এগিয়ে আসার পোস্ট দেখে দেখে আমি এখন অসুস্থ হয়ে হতাশায় পড়ে যাচ্ছি। কেন সবার সঙ্গে এসব মহৎ কাজে থাকতে পারছি না।
ফেসবুকে আমার বন্ধু সংখ্যা এক হাজারের কিছু বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ জনের পোস্ট হলো সাহায্য করুন। অনেকে ইনবক্সও করেন। সাহায্য না করলে গালাগাল করেন, মিথ্যা ভাব লই বইলা কথাও শুনিয়ে দেন। এখন আমি কই যাই? ৩০০ জনকে ১০০০ টাকা করে দিলে আমার তিন লাখ টাকা দরকার। কিন্তু এ তো আমার হিসাব। সত্যি হলো ১০০০ টাকা দিলে টিপ্পনি মার্কা ইমো পেতে ১ সেকেন্ডেরও ১০০ ভাব কম ন্যানো সেকেন্ড সময় লাগে। এখন আমি কী করি!
আমি বলছি না এই ধরনের সাহায্য করবার সুযোগ বন্ধ করা উচিত। বলছি কেবল এ যেন মহামারী হয়ে উঠছে। দেখাবার ইচ্ছায়। আপনি এতিম কিছু বাচ্চার জন্য জামা কাপড়ের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিতেই পারেন। পরিচিত জনদেরকে বলতেও পারেন সঙ্গে থাকতে। কিন্তু সেটা ঘটা করে ফেসবুকে আপলোড করে সাহায্য চাইবার নামে অন্যর মানসিক চাপ তৈরি করার প্রয়োজন কি খুব আছে ? ৩০০ জনের সঙ্গে দাঁড়াতে হবে বলে আমার যে তিন লাখ টাকা দরকার সেটা কে দেবে? তার চেয়ে থাকতে দিন না আমার চারপাশের মানুষদের নিয়ে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে সুখী। আমরা প্রত্যেকে আমাদের গণ্ডির মধ্যে থাকি একে অন্যের হাত ধরে।
দেখুন, আমি জাকাত দেবে আমার পরিচিত মানুষদের। প্রতিবেশীদের। আত্মীয়দের। আমি সামান্য একজন মানুষ। আমাকে গণ্ডির ভেতর থাকতে দিন। আমাকে আপনার গণ্ডিতে টানার চেষ্টা করে কেবল হতাশা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আমি আপনি মিলে কিচ্ছু হবে না তা না। কিন্তু সে প্রয়োজনের তুলনায় বড্ড কম। তার চেয়ে বরং চলুন সরকারকে বাধ্য করি কিছু করতে গরীব দুঃখী অসহায় মানুষদের জন্য। আর আমরা কেবল আমাদের প্রতিবেশীদের জন্য করি। প্রত্যেকে যদি প্রতিবেশীর জন্য করি, নিজের আত্মার জন্য করি। ফেসবুকে দেখানোর জন্য নয়। অন্যকে না পারার ব্যর্থতায় ডুবিয়ে দেওয়ার অধিকার আমাদের কারো নাই।
লেখক : উদ্যোক্তা