হারিকেন নিভে গেল, আলো এলো না!
১৯৭০ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের(কাউন্সিল) মার্কা ছিল হারিকেন । তখন রৌমারী-রাজীবপুরের মানুষজন স্লোগান দিতেন, হারিকেনে তেল নাই , মুসলিম লীগের ভোট নাই"। ফলাফল যা হবার তাই হলো। নৌকা ঝড়ে হারিকেন নিভে গেল। কলের নৌকা, জলের নৌকা সব যেন ডাঙ্গায় চলে এসেছিল।
তেলবিহীন নিভু নিভু হারিকেন পশ্চিমে চলে গেল, ইতিহাসের সাদাকালো প্রান্তরে স্বাধীন বাংলা হাজির হলো, কিন্তু আর কোনো প্রজ্জ্বলিত হারিকেন কুড়িগ্রামবাসীর গৃহ আলোকিত করল না। জীর্ণগৃহগুলোর ১৫ শতাংশ এখন অব্দি বিদ্যুতের নাগাল পায়নি।
দৈনিক প্রথম আলো খবর ছেপেছে দারিদ্র্যের তালিকায় কুড়িগ্রাম শীর্ষে, সবচেয়ে কম দারিদ্র্য কুষ্টিয়ায়।ইতিহাসের থেকে বর্তমান পর্যন্ত খেয়াল করলে দেখবেন , নামের আদিবর্ণের মিল থেকে শুধু নয় আরো বেশ কিছু ক্ষেত্রে কুড়িগ্রামের সঙ্গে কুষ্টিয়ার সম্পর্ক আছে।
কুড়িগ্রাম ও কুষ্টিয়া একইদিনে, ৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয়েছিল। কিন্তু এই সাদৃশ্য চরম বৈসাদৃশ্যে পরিণত হয়নি কি? একই দিনে স্বাধীন হয়ে একটি জেলায় দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি আরেকটিতে সবচেয়ে কম।কিন্তু কেন?
উন্নয়নের ট্রেন ধরতে গিয়ে দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে কুড়িগ্রামকে।অথচ উন্নয়নের সূচকে উপরের দিকে উঠবার ক্ষেত্রে কুষ্টিয়ার থেকে কুড়িগ্রামের সম্ভাবনা কম ছিল না। সে সম্ভাবনা আজও সামান্যতমও ফুরিয়ে যায়নি। কেবল সে সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো দরকার।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকার । বাংলাদেশের বাজারে ভারতের একচেটিয়া বাণিজ্য চলমান রয়েছে । এই বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর ক্ষেত্রে কুড়িগ্রাম হয়ে উঠতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।ভারতের কেন্দ্রীয় স্নেহবঞ্চিত তিনটি রাজ্যের সঙ্গে সীমানা রয়েছে কুড়িগ্রামের। আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে শিল্পের বিকাশ ততখানি ঘটেনি যতখানি বাংলাদেশে ঘটেছে।দিল্লি কলকাতা থেকে এই রাজ্যগুলোতে পণ্য নিয়ে যেতে যে খরচ পড়বে, কুড়িগ্রাম সীমানা দিয়ে পণ্য ঢুকলে খরচ পড়বে তার চেয়ে অনেক কম।উপরন্তু বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি করা গেলে সেখানকার ক্রেতারাও উপকৃত হবে। এসব রাজ্যে ব্যবসা করা গেলে কুড়িগ্রামকে উপলক্ষ করেই ফি বছর পাঁচ থেকে দশ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব।এ হিসাব নিছক কল্পনা নয়।
এ ক্ষেত্রে উদাহরণ টানা যেতে পারে। আসাম ত্রিপুরায় পথের বাঁকে বাঁকে বাংলাদেশের প্রাণের বিলবোর্ডগুলো কি প্রমাণ করে! সেখানে প্রাণ জুস প্রাণ লাচ্চির বেশ ব্যবসা চলছে।আসলে উল্লেখিত রাজ্যগুলোর ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতেও আগ্রহী। তবে এ ক্ষেত্রে ভারতের পক্ষ থেকে কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে যেগুলোকে অপসারণ করতে হবে । বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে গেলে ভারতীয় আমদানিকারকদের ১১০শতাংশ টাকা দিয়ে এলসি খুলতে হয় । অপরদিকে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের প্রতিবছরই দিল্লি থেকে লাইসেন্স নবায়ণ করতে হয় । এ ছাড়া রুপি-ডলার-টাকার রুপান্তর প্রক্রিয়া বেশ জটিল।সদিচ্ছা থাকলে সরকার এসব সমস্যার সমাধান করে রৌমারী-রাজীপুর-ভুরুঙ্গামারী সীমান্তে গার্মেন্টস, খাদ্য, হার্ডওয়ার শিল্প গড়ে তুলতে পারে । তাতে কুড়িগ্রামের লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান যেমন হবে তেমনি এই এলাকার অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে।
২০১৪ সালের জেলাওয়ারী বাজেটে দেখা গেছে, রংপুর বিভাগের আটটি জেলার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা, আর শুধু টাঙ্গাইল জেলার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে দুই হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। এমনতর বৈষম্য এখনো বহাল আছে। এভাবে বৈষম্য জিইয়ে রেখে অবেহেলিত, দারিদ্র্যকবলিত জেলাগুলোকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে কি!এ দেশের সংবিধানে পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোকে অতিরিক্ত বাজেট দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।কিন্তু তার বাস্তবায়ন দৃশ্যমান হয়েছে কি!রিলিফের চাল, আটা ময়দা সুজি নিয়ে লাভ নেই।কর্মসংস্থান করে নিতে হবে, টেকসই উন্নয়নের দিকে যেতে হবে। একযোগে এককালীন ১০ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে এখানে।
ভাবছেন, অত টাকা!গত দুই বছরে শুধু রেলওয়ের মাস্টার প্ল্যানেই ৩৫ হাজার কোটি টাকা গেছে । ৫০ বছর ধরে অবহেলিত একটি জেলার উন্নয়নে এ টাকা মামুলি নয় কি!
সম্প্রতি পার্বতীপুর-পঞ্চগড় রুটে ব্রডগেজ রেল লাইন বসানোয় পুনরায় ওই অঞ্চলে ভারত-বাংলাদেশ রেলচালু হয়েছে।মাসখানেক আগে প্রথম আলোতে খবর ছেপেছে, ভারত থেকে পঞ্চগড়ে পাথর নিয়ে আসা একটি ট্রেনেই বাংলাদেশের আয় হয়েছে ২৪ লাখ টাকা।
কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারীতেও ভাগ্যাহত একটি স্থলবন্দর রয়েছে। ৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের আগেও কুড়িগ্রাম(ভুরুঙ্গামারী) থেকে ভারত অব্দি রেল চলত । এখনো সেটা সম্ভব।কুড়িগ্রামের পুরাতন স্টেশন থেকে সোনাহাট স্থলবন্দর হয়ে ভারত অব্দি রেলপথ বসাতে কত কোটি টাকা খরচ হবে? বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ৭০০ থেকে ৮০০কোটি টাকায় কাজটি করা সম্ভব।
আর সেটা করতে পারলে কুড়িগ্রামর চেহারা কতখানি বদলে যাবে, ভেবে দেখুন তো!
কুড়িগ্রাম স্টেশন হবে জংশন। একটি লাইন যাবে চিলমারী বন্দরের দিকে অপরটি সোনার হাট স্থলবন্দর হয়ে ভারতের দিকে। রেলের মাধ্যমে বন্দর থেকে অন্দর, অন্দর থেকে বন্দরে মালামাল পরিবহন হবে।
যে নামই দিন, ধরলার তীরে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে। আসাম ত্রিপুরা মেঘালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও সেখানে আসতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল কুড়িগ্রামের মানুষ।যুদ্ধের শুরু থেকেই রৌমারী ছিল মুক্তাঞ্চল।
যে স্বপ্নের জোরে এ অঞ্চলের কৃষক লাঙল ফেলে অস্ত্র ধরেছিল, ছাত্রটি কলম ফেলে অস্ত্র ধরেছিল, শ্রমিক কাজ ফেলে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল, সে স্বপ্ন কত দূরে?
লেখক : সংগঠক, রেল-নৌযোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।