অভিমত
মুক্তিযুদ্ধের খেতাব ও জনযুদ্ধের সংকট
চার নং সেক্টরের সাব কমান্ডার মাহবুব রব সাদী ৭২-এ তাঁকে প্রদত্ত ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব বর্জন করেন। মাহবুব সাদীর খেদ ছিল- ‘আমি নিজে অন্তত তিন জনের কথা জানি যাদের বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পাওয়া উচিত ছিল।’ কিন্তু দেওয়া হয়নি। ১৯৯৪ সালে পুনরায় তাঁকে পদক গ্রহণের আহ্বান জানালে তখনো তিনি প্রত্যাখ্যান করে বলেন- ‘মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা বিভিন্ন পদক পেয়েছেন তাঁদের বীরত্ব ও অবদানকে খাটো করি না। কিন্তু অন্য যাঁরা যথাযথ বীরত্ব প্রদর্শন করে এবং অবদান রেখেও যথাযথ মূল্যায়ন পাননি তাঁদের আত্মার প্রতি সম্মান দেখাতেই আমি এ খেতাব ও পদক বর্জন করেছি (অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি/অপূর্ব শর্মা)।’
উপমহাদেশের ইতিহাসে একমাত্র বাংলাদেশ জনযুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করে। লেনিনের মহত্তম সোভিয়েতেও জনগণের অংশগ্রহণ বাংলাদেশের মতো এত নিরুঙ্কুশ ছিল না। সশস্ত্র অংশ নেওয়ার বাইরে এ দেশের প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে সক্রিয় ছিল মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। ১৯৮৭-তে প্রকাশিত ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ গ্রন্থেও এ ব্যাপারে আক্ষেপ করে বলা হয়েছে- স্বাধীনতার পর আমাদের প্রথম ভুল হয়েছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রস্তুতের কাজ। আমাদের উচিত ছিল ঘাতক ও দালালদের তালিকা তৈরি করা।
৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ জনগণের যুদ্ধ ছিল কি না- এটি একটি অবান্তর প্রশ্ন। কিন্তু সশস্ত্র সমরে অংশ নেওয়ার জন্য যে খেতাব দেওয়া হয়, তাতে মুক্তিযুদ্ধের ‘জনযুদ্ধ’ পরিচয় অস্বীকৃত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের খেতাবের পরিসংখ্যান দেখলে মনে হতে পারে, যুদ্ধটি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের দুটি নিয়মিত বাহিনীর মধ্যেই সংঘটিত হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব রব সাদী তাঁর খেতাব বর্জনের মাধ্যমে সম্ভবত এ বিষয়টি আমাদের সামনে তুলে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও অবদানের জন্য প্রদত্ত খেতাব ও পদকের ৮০ ভাগই কেন সশস্ত্র বা নিয়মিত বাহিনী থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত হলো! ‘একাত্তরে দিরাই-শল্লা’ প্রবন্ধে সালেহ চৌধুরী বলেছেন, ‘জগৎজ্যোতি শহীদ হওয়ার তিন-চারদিন পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয় যে তাকে সর্বোচ্চ মরণোত্তর খেতাব দেওয়া হবে। কিন্তু স্বাধীনতার পর সরকার জ্যোতিকে সর্বোচ্চ খেতাব দেয়নি, সর্বোচ্চ খেতাব মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ একটি অংশের জন্য সীমাবদ্ধ রয়ে গেল। সরাসরি সশস্ত্র বাহিনীর না হলে সর্বোচ্চ খেতাব দেওয়া যাবে না।’
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের খেতাব চারটি। ১৯৭৩-এর ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পদকপ্রাপ্তদের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। এতে চারটি খেতাব মিলিয়ে মোট ৬৭৬ জনকে পদক দেওয়া হয়। এতে সশস্ত্র বাহিনী থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধা ৫২০, আর বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১৫৬ জন। বিস্তারিত পরিসংখ্যানে এই বৈষম্য আরো প্রকট হয়ে ওঠে। সর্বোচ্চ খেতাব ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ পদক দেওয়া হয় ৭ জনকে। এই পদকটি কেবল সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব ‘বীরউত্তম’ দেওয়া হয় ৬৮ জনকে, এতে সশস্ত্র বাহিনী থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধা ৬৬ আর বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা ২ জন। তৃতীয় খেতাব ‘বীরবিক্রম’ ১৭৫টির মধ্যে সশস্ত্র বাহিনী ১৪২, বেসামরিক ৩৩। চতুর্থ এবং সর্বশেষ ‘বীরপ্রতীক’ ৪২৬টি পদকের মধ্যে ৩০৫টি সশস্ত্র বাহিনী, বাকি ১২১টি দেওয়া হয় বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের। লক্ষণীয় যে মুক্তিযুদ্ধের পদকে দুজন মহিলা, একজন বিহারি, একজন বিদেশি ও পাঁচজন হিন্দু রয়েছেন। অথচ দেড় হাজার শহীদের অধিকারী হলেও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কাউকেই এই পদক দেওয়া হয়নি। ইতিহাসের দায় থাকলে, ভারতের প্রতি এ আচরণ আমাদের কৃতঘ্নতা হিসেবেই বিবেচিত হবে।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী আমাদের রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনে বিবিধ ব্যর্থতার কারণে সমাজতাত্ত্বিকেরা অভিযোগ করেন, একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু জনগণের মুক্তি আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের পদক প্রদানে ব্যুরোক্র্যাসি ও সাধারণ জনগণের এই বৈষম্যের মধ্যে কি তারই কোনো ইঙ্গিত রয়েছে!
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী দলটি দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ ও বিকৃতিরোধে তৈরি করা হচ্ছে নানা অনুশাসন। কিন্তু এরচেয়ে জরুরি হলো ইতিহাসের পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠন। আমাদের এটাও খুঁজে বের করা দরকার যে- ঔপনিবেশিক ইতিহাসকাঠামোর ফেরে মুক্তিযুদ্ধের কী কী ক্ষয়, ক্ষরণ ও চেতনার বিপথগমন ঘটেছে। ১৮৫৭ সালের ‘সিপাহী হাঙ্গামা’কে আমরা ভারতের প্রথম ‘জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম’ হিসেবে পুনর্গঠন করতে পেরেছি। ‘ভাস্কো দা গামা ভারতবর্ষ আবিষ্কার করেন’কে আমরা উপনিবেশিক চৈতন্য থেকে মুক্ত করে শনাক্ত করেছি ‘ভাস্কো দা গামা হলেন আধুনিক ইউরোপীয়দের একজন যিনি প্রথম ভারতবর্ষে আসেন।’
সুতরাং সাত বীরশ্রেষ্ঠর সংখ্যাও আমরা উন্নীত করতে পারি। জনযুদ্ধের দায় মেটাতে দরকার অন্য খেতাবগুলিরও পুনর্নির্মাণ। অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র প্রতিরোধে সর্ববৃহৎ বাহিনী টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। ‘বঙ্গবীর’ নামে কিংবদন্তি হয়ে ওঠা কাদের সিদ্দিকীকে ‘বীরউত্তম’ খেতাব দেওয়া হয়। অথচ দ্বিতীয়বৃহত্তম বাহিনী সিরাজগঞ্জ-পাবনার পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের অধিনায়ক আবদুল লতিফ মির্জাকে কোনো খেতাব দেওয়া হয়নি। একইভাবে, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের জন্য তাজউদ্দিন আহমেদ, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নিয়ে আমাদের যে জাতীয় ‘চারনেতা’র ইমেজ, তার সংখ্যাও উন্নীত হওয়া দরকার। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং দেশ পুনর্গঠনে অত্যুচ্চ ভূমিকার জন্য মণি সিংহ এবং মোজাফফর আহমদকেও একই আসনে মহিমা না দিলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মুক্তি আসবে না।
লেখক : সহকারী বার্তা সম্পাদক, নাগরিক টেলিভিশন