এক্সট্রা কাভার
টাইগারদের ভালো করার রহস্য কী?
মুস্তাফিজের ‘স্লোয়ার’ রহস্যে এতটাই ডুবে আছে ক্রিকেট-মহল যে ইচ্ছা থাকলেও কেউ জিজ্ঞেস করতে পারছেন না—মাশরাফি, বিশ্বকাপের আগে থেকে বাংলাদেশের বদলে যাওয়ার রহস্যটা কী? বিশ্বকাপে ভালো পারফরম্যান্স। দেশের মাটিতে পাকিস্তানকে ৩-০ ব্যবধানে গুঁড়িয়ে দেওয়া। এর পর ভারতের বিপক্ষে ২-১-এ সিরিজ জয়। এই সাফল্যের ফর্মুলা কী?
মাশরাফি কী বলবেন, জানি না। তবে ক্রিকেট মাঠে এত কনসিসটেন্ট পারফরম্যান্স বাংলাদেশ আগে কখনো করেনি। করতে পারেনি। যেটা করছে মাশরাফি বিন মুর্তজার অধিনায়কত্বে আর চন্দিকা হাথুরুসিংহের কোচিংয়ে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এই দুজন লোক সাফল্য নিয়ে খুব একটা কথা বলছেন না। কথা বলার আগ্রহ দেখাচ্ছেন না! সাফল্যের অংশীদারিত্ব নিয়ে যে সমাজে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়, সেখানে চন্দিকা হাথুরুসিংহে নিশ্চুপ থাকতে পারেন, কোচ হিসেবে এটাই বোধ হয় তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ। বাংলাদেশের এসব সাফল্যের পর স্পন্সর কোম্পানি যতই তাঁকে এবং তাঁর সাপোর্ট স্টাফদের অভিনন্দন জানিয়ে বিজ্ঞাপন দিক না কেন, তাতে হাথুরুসিংহে সামান্যতম নড়েচড়ে বসবেন বলে মনে হয় না। আর তিনি ‘আমি’ নয়, ‘আমরা’ মানে ‘দল’-এ বেশি আগ্রহী সব সময়। হাথুরুসিংহে লংকান। কিন্তু ক্রিকেটোত্তর জীবনে বসবাস সিডনিতে। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দর্শন তাঁর কোচিংয়ে। হাথুরুর কোচিংয়ে বিগ ব্যাশে এক মৌসুম খেলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক তারকা মাইক হাসি। গত বিশ্বকাপের সময় যিনি সাউথ আফ্রিকান টিমের ব্যাটিং কনসালট্যান্ট ছিলেন। সেই হাসি সিডনিতে বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলার সময় বারবার বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ দলটা যেভাবে পাল্টে গেল, তার পেছনে চন্দিকার বড় অবদান। ওর কিছুটা কৃতিত্ব প্রাপ্য।’ অবশ্যই প্রাপ্য। এবং সেটা দিতে বাংলাদেশের মানুষ কার্পণ্য করছে তাও নয়; বরং বিসিবি সভাপতি নিজেই দরাজ গলায় হাথুরুসিংয়ের প্রশংসা করেছেন। তিনি প্রশংসা করেছেন অধিনায়ক মাশরাফিরও। আধুনিক ক্রিকেট ক্যাপ্টেন-কোচের পার্টনারশিপটা খুব জরুরি। এই দুজনের মধ্যে বোঝাপড়াটা ঠিকঠাকমতো না থাকলে সাফল্য পাওয়া কঠিন। সেই জায়গাটায় মাশরাফি-চন্দিকা এখন পর্যন্ত একজন আরেকজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আর এই শ্রদ্ধাটা আদায় করে নেওয়াও এক ধরনের স্কিল।
তবে মাশরাফি ও চন্দিকা সবচেয়ে ভালো স্কিল দেখিয়েছেন দলের মধ্যে একটা বিশ্বাসের জন্ম দেওয়ার ব্যাপারে। দলটা এখন বিশ্বাস করতে শিখেছে, ‘আমরাও পারি।’ এই বাংলাদেশ ম্যাচ জিততে দারুণ আগ্রহী। তারা প্রতিটি ম্যাচ জিততে চায়। সেখানে প্রতিপক্ষের নাম ভারত বা পাকিস্তান যা-ই হোক। ড্রেসিংরুমে ভালো পরিবেশ না থাকলে এই বিশ্বাস দলের ভেতর সঞ্চারিত হতে পারে না। বিশ্বকাপ এবং বিশ্বকাপ-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান-ভারতের বিপক্ষে ভালো ক্রিকেট খেলার পর বলা এখন খুব সহজ, বাংলাদেশ আত্মবিশ্বাসী দল। তারা প্রতিটি ম্যাচ জিততে চায়। ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ ভালো খেলছে। তবে দলের ভেতর এই বিশ্বাস ঢোকানোর কাজটা মোটেও সহজ ছিল না হাথুরুসিংহে কিংবা মাশরাফির জন্য। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে এর জন্য।
মাশরাফি-হাথুরুসিংহের পাশাপাশি কিছুটা কৃতিত্ব দাবি করতেই পারেন নির্বাচকরা। ফারুক-নান্নু-সুমন অনেক তরুণকে সাহস দেখিয়ে ব্রেক দিয়েছেন। সেই তরুণরা অবশ্য নির্বাচকদের আস্থার প্রতিদানও দিয়েছেন পারফর্ম করে। দল দিয়ে কোচ যে সব সময় খুশি হয়েছেন, তা-ও নয়। আবার নিজের চাহিদামতো দল তিনি সব সময় পাবেন, তা-ও হতে পারে না। যদি তাই হতো, তাহলে নির্বাচক কমিটির দরকার পড়ত না। বিশ্বের কোনো দেশেই নির্বাচক প্যানেল থাকত না; রাখার প্রয়োজন পড়ত না। কোচকেই বলা হতো, তুমি তোমার মতো দল বেছে নাও। তবে হাথুরুসিংহের বড় কৃতিত্ব হতে পারে, যে দলটা তিনি পেয়েছেন, সেখান থেকে ঠিকঠাক কম্বিনেশন তৈরি করা। আবার এটাও ঠিক, যে তরুণরা সুযোগ পাচ্ছেন, তারা পারফর্ম করছেন। সৌম্য সরকার, লিটন দাস, মুস্তাফিজ, জুবায়ের হোসেন সাম্প্রতিক সময়ে এরাই দলে সুযোগ পাওয়া আলোচিত নাম। আর তাঁরা আলোচনায় এসেছেন পারফর্ম করেই।
ক্রিকেটে ক্যালকুলেটিভ রিস্ক বলে একটা কথা আছে। হিসাব-নিকাশ করে আপনাকে ঝুঁকি নিতেই হবে। মুস্তাফিজের মতো তরুণকে নিয়ে বাংলাদেশ যে ঝুঁকি নিয়েছিল, ভারতের বিপক্ষে সিরিজে সেখানে তাঁরা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সফল। উনিশ বছরের এই বাঁহাতি তরুণ প্রায় একাই ভাগ্য গড়ে দিলেন বাংলাদেশ-ভারত সিরিজের। সাতক্ষীরার এই তরুণ এখন ক্রিকেট মহলে সবচেয়ে আলোচিত নাম। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ১৩ উইকেট! অভিষেকের পর তিন ম্যাচে ১৩ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব আগে কেউ দেখাতে পারেননি। মুস্তাফিজ দেখালেন। ক্রিকেট-বিশ্বের ফোকাস নিজের দিকে টানলেন। কোচ-অধিনায়কের আস্থার প্রতিদানটা তিনি এভাবে দিলেন। মাঠে মুস্তাফিজ-সৌম্যদের এই পারফরম্যান্স হচ্ছে মাঠের বাইরে অধিনায়ক মাশরাফি যেভাবে দলটাকে গুছিয়ে নিয়েছেন, যেভাবে দলটাকে আগলে রাখছেন, তারই ফসল। আসলে একটা দলের সাফল্যের কোনো সহজ-সরল ফর্মুলা নেই। ফর্মুলা একটাই, কোচ-অধিনায়ক ম্যাচ নিয়ে যে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করেন, মাঠের মধ্যে ক্রিকেটারদের সেটা বাস্তবায়ন করা। যে দল যত নিখুঁতভাবে সেটা করতে পারছে, তারা তত সফল। বাংলাদেশ সবে সাফল্যের পথে পা বাড়িয়েছে।দলটাকে নিয়ে এখনই খুব বেশি মাতামাতি না করাই ভালো। দলের কোচ-অধিনায়ক বারবার সে কথাটাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন। আমরা মনে রাখতে পারব তো?
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক