অভিমত
বই-ই মানুষকে পরিপূর্ণ করে
একটা সময় মানুষের বিনোদনের প্রধান মাধ্যমই ছিল বই। বই পড়ার কিন্তু নির্দিষ্ট কোন সময়সীমা ছিল না তখন।যার যখন খুশি; তখনই বই নিয়ে বসে যেত। বই নিয়ে আমারও অনেক মজার মজার স্মৃতি আছে। যখন খুব ছোট ছিলাম। বাজারে যাওয়া তখনও শিখিনি। বড়জোর বাড়ির পাশের কলেজটাতে যেতাম বিকেলে খেলাধুলা করতে ।
তখন কলেজে বইয়ের ছেঁড়া পাতা কিংবা পত্রিকার পাতা পেলেই পড়তে লেগে যেতাম। স্কুলে বাদাম দিত যে কাগজে; সেই কাগজটি না ফেলে- কী লেখা আছে তাতে নিমিষেই পড়ে নিতাম। বাড়ির পাশের ওষুধের দোকানে গিয়ে নিয়মিত পত্রিকা পড়তাম। আমার বাবা-মা বেশি শিক্ষিত না হলেও তাঁরা কিন্তু কখনোই পড়ার ব্যাপারে বাধা দিতেন না। বরং আরো উৎসাহ দিতেন।
বলা ভালো আমি পাঠ্য বইয়ের চেয়ে ফিকশন-নন ফিকশন বই-ই বেশি পড়তাম; যখন একটু বড় হলাম।বাজারে আব্বা আমাকে সাইকেলে চড়িয়ে নিয়ে যেতেন। তখন আমি কোনো কিছু খেতে চাইতাম না। আমার আবদার ছিল বইয়ের। সময়টা ছিল ৯৫/২০০৭ এর দিকে। তারপর থেকে বইয়ের প্রতি আস্তে আস্তে কেমন যেন আগ্রহ কমে গেল। কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ করিনি ।
সময় বদলেছে, এরই মধ্যে বদলে গেছে অনেক কিছু। আমি বদলেছি, আপনিও বদলেছেন, অনেকেই বদলেছে। প্রযুক্তির প্রসারতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ ঝুকে গেছে প্রযুক্তির দিকে। বই ঢুকে গেছে প্রযুক্তির ভেতর। কিন্তু তাতে আর অতটা মজা নেই। বলাবাহুল্য বইয়ের পিডিএফ ভার্সন পড়লে মনে হয় যেন খেলনা বই পড়ছি কিংবা কোনো কৃত্রিমতাকে অনুসরণ করছি।
আজ বিশ্ব বই দিবস। ১৯৯৫ সালের ২৩ এপ্রিল হতে প্রতিবছর জাতিসংঘের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কোর উদ্যোগে এই দিবসটি পালন হয়ে আসছে। এ বছর বই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘বই পড়া, বই ছাপানো, বইয়ের কপিরাইট সংরক্ষণ করা’ ইত্যাদি বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো।
বই দিবসের ইতিহাস বা ইতিবৃত্ত জানাটাও কিন্তু খুব জরুরি। ১৯৮২ সালে ইউনেস্কো লন্ডনে আন্তর্জাতিক গ্রন্থ-সম্মেলনের আয়োজনে ১০ বছর ‘পড়ুয়া সমাজ’ গঠনের প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়। সেই সম্মেলনের ১৩ বছর পর ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো প্রতি বছর ২৩ এপ্রিলকে সব দেশকে বিশ্ব গ্রন্থ ও কপিরাইট দিবস হিসেবে পালন করার আহ্বান জানায় এবং ১৯৯৫ সাল থেকে দিবসটি উদযাপন শুরু করে। স্কুলের বার্ষিক ছুটির কারণে এর আগে থেকেই অবশ্য গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ড ৪ মার্চকে বিশ্ব গ্রন্থ দিবস হিসেবে পালন করে আসছিল।
কয়েকটি কারণে ইউনেস্কো ২৩ এপ্রিলকে গ্রন্থ দিবস ঘোষণা করেছিল। আধুনিক উপন্যাসের জনক ও বিখ্যাত উপন্যাস ‘ডন কুইকসোট’-এর লেখক স্পেনীয় ঔপন্যাসিক কারভানতির মৃত্যুদিন ২৩ এপ্রিল বড় একটি কারণ। অন্যদিকে শেক্সপিয়রের জন্মদিন। আবার স্পেনে ১৯২৫ সালের এই দিনটি থেকে প্রেমিককে একটি গোলাপ ফুলের বদলে বই উপহার দেয় প্রেমিকা। সেখানে বই উপহার দেওয়ার দিন হিসেবে আজও উদযাপিত হয়ে আসছে ২৩ এপ্রিল। অন্যদিকে বিশ্বের বেশ কয়েকজন বিখ্যাত লেখকের জন্মদিন ২৩ এপ্রিল। যেমন আধুনিককালের অন্যতম বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ভ্লাদিমির নবোকভ।
তবে সম্ভবত শেক্সপিয়রের জন্মদিন ও কারভেনতিসের মৃত্যুদিন এবং স্পেনে ‘বই উপহার দেওয়ার দিন’ হিসেবে এদিন উদযাপিত হয়ে আসছে অনেক দিন ধরে। সেই বিবেচনায় আজ (২০১৭) থেকে ২২ বছর(১৯৯৫) আগে দিনটিকে বিশ্ব গ্রন্থ ও কপিরাইট দিবস হিসেবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউনেস্কো।
বই পড়ারও কিছু বিশেষত্ব আছে। মণীষীদের মতে নিচের দশটি কারণে প্রতিটি মানুষেরই নিয়মিত বই পড়া দরকার-
১) মানসিক উদ্দীপনা বাড়াতে: স্থবির মনের উদ্দীপনা বাড়াতে বইয়ের চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না।
২) স্ট্রেস কমানো : খুবই মানসিক চিন্তায় আছেন। সুন্দর একটি বই পড়া শুরু করুন। দেখবেন অবসাদ কমে যাচ্ছে।
৩) জ্ঞান বাড়াতে : কথা একটাই বই হলো জ্ঞানের ভাণ্ডার।
৪) শব্দভাণ্ডার বিস্তার : একমাত্র বই পড়ার মাধ্যমেই আপনি নতুন শব্দভাণ্ডারে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারেন।
৫) স্মৃতি উন্নয়ন : বই আপনার স্মরণশক্তি বাড়াতে দারুণ এক কার্যকরী ভূমিকা রাখে ।
৬) বিশ্লেষণাত্মক চিন্তার দক্ষতা : বই পড়ার মাধ্যমে আপনার যেকোনো একটা বিষয়ে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা অথবা দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
৭) চিন্তার উৎকর্ষতা : শুধু যে আপনি ভালো বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা অর্জন করবেন তা না। ভালো বই পাঠ চিন্তার উৎকর্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে।
৮) ভালো লেখার ক্ষমতা : বই পড়লে শুদ্ধ করে, সুন্দর শব্দ চয়নে লিখার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ।
৯)প্রশান্তি : মানসিক প্রশান্তি বাড়াতে বইয়ের চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না।
১০) বিনোদন : নির্জনতায় নিজের মতো করে শব্দহীন বিনোদন চান। নিজের মাঝে নির্মল পরিবেশের সুন্দর একটি আবহ তৈরি করতে চান। তবে বই, বই আর বই।
আপনি একটু যাচাই করে দেখবেন, বই পড়ুয়ারা কিন্তু কথা খুব কম বলে। তারা অন্যর কথা মনোযোগের সঙ্গে শোনে। আর দুই/একটি কথা বললেও রেফারেন্স বা কোটেশন ছাড়া বলে না। তাই বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা উৎসবে আমরা বই উপহার দেওয়ার রীতি চালু করি।
পৃথিবীর সব লেখক, পাঠক, মুদ্রাকর, ছাপাকর্মী, বইয়ের বিপণনকারীসহ বইয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষাভাবে সম্পৃক্ত সবাইকে বিশ্ব বই দিবসের শুভেচ্ছা ।
আসুন বই পড়ি, জীবন গড়ি। পৃথিবীকে জানার চেষ্টা করি।
লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক।