লাকী আখন্দ
ফেরারী পাখিরা কুলায় ফেরে না
পুরোদস্তুর সহজাত একজন ভালোবাসার গীতিকবি এবং কিংবদন্তী গায়ক লাকী আখন্দ তাঁর যৌবনেই গেয়েছিলেন, ‘আমায় ডেকো না, ফেরানো যাবে না/ ফেরারী পাখিরা কুলায় ফেরে না/ শেষ হোক এই খেলা এবারের মতন/ মিনতি করি আমাকে হাসিমুখে বিদাও জানাও।’
কবির বয়ানে, বিবাগী মন নিয়ে তাঁর জন্ম বলে আজন্মই ফেরারী এই কবি তাঁর জীবনবেলার সকল খেলা সাঙ্গ করে অনন্তে পা রাখলেন। শ্রোতা ও ভক্তের অশেষ ভালোবাসা নিয়ে সকল কিছুর বাইরে চলে গেলেন তিনি। কোনোদিন গণ্ডিবদ্ধ বাঁধাধরা জীবনজালে জড়াতে চাননি নিজেকে। কবি বলতেন, কোনো কিছুর টানের মায়ায়ই তাঁকে বাঁধা যায় না। কবিকল্পনা সার্থকই হলো। আর চিরচেনা কুলায় ফিরবেন না তিনি। তবে এমন মহত্তম শিল্পীর কোনো আত্মিক মরণ নেই। অমরত্ব তাঁর জীবন সংহিতা। তাই কবির মিনতি মনে রেখেই কারুণ্যভরা হাসিমুখে বলছি, বিদায় সুপ্রিয় কবিবর। গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি শিল্পী লাকী আখন্দ।
আশির দশকের জনপ্রিয় সুরকার, শিল্পী ও সংগীত পরিচালক লাকী আখন্দকে বিদায় জানাচ্ছি আমরা। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (মিটফোর্ড) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই প্রথিতযশা শিল্পী। ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর লাকী আখন্দের ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর ব্যাংককের একটি হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা করানো হয়। থাইল্যান্ডের পায়থাই হাসপাতালে তাঁর যকৃতে অস্ত্রোপচারও করা হয়। এরপর দেশে এসে কিছুদিন থাকার পর একই বছরের নভেম্বরে আবারও ব্যাংককে গিয়ে শরীরে ছয়টি কেমো নিতে হয়েছিল তাঁকে। কেমো শেষ করে ২০১৬ সালের ২৬ মার্চ দেশে ফেরেন তিনি। গত বছরেও ঢাকার তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন লাকী আখন্দ। তাঁর শরীরে মোট নয়টি কেমো দেওয়া হয়েছিল।
কেমো শেষে সুস্থ্যবোধ করলে পাহাড়ে গিয়ে বাস করার পরামর্শ ছিল চিকিৎসকদের। কিন্তু অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা আজন্মের ফেরারী লাকী আখন্দের ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা/ শুধু দু’জনে/ চলো না ঘুরে আসি অজানাতে/ যেখানে নদী এসে থেমে গেছে’ গাইতে গাইতে পাহাড় যাত্রায় আর যাওয়া হলো না!
জীবনের শেষবেলায় কর্কটরোগের ভোগান্তির কালেও ভক্ত শ্রোতার অকৃত্রিম অপরিসীম ভালোবাসায় আপ্লুত হয়েছেন তিনি। তাঁর চিকিৎসা সহায়তায় কনসার্ট করে টাকা তোলা হয়েছে। সেসব কনসার্টে একালের শিল্পীরা দরদ দিয়ে লাকী আখন্দের গাওয়া ও সুরারোপ করা ‘এই নীল মণিহার’, ‘আমায় ডেকো না’, ‘আগে যদি জানতাম’, ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’, ‘মা-মনিয়া’, ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে’, ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’, ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, ‘ভালোবেসে চলে যেও না’, ‘লিখতে পারি না কোনো গান’, ‘কি করে বললে তুমি’ ইত্যাদি গান গেয়ে ভক্ত-শ্রোতাদের মাত করেছেন। শিল্পীকে ভালোবেসে স্রোতারা টিকিট কেটে গান শুনেছেন। এই বিষয়গুলো লাকী আখন্দকে অশেষ আনন্দে ভাসিয়েছে। ভক্তের এমন ভালোবাসার খবরগুলো তিনি হাসপাতালের বেডে শুয়েও যত্ন নিয়ে পড়েছেন, দেখেছেন ও অনুধাবন করেছেন। ব্যক্তির জীবদ্দশায় এমন শিল্পী অন্তপ্রাণ ভক্তের ভালোবাসা ক’জনারই বা ভাগ্যে জোটে? লাকী আখন্দ সেই হাতে গোনা গুটি কয়েক মহৎ মানুষদের একজন, যিনি মানুষের অফুরান ভালোবাসার অনন্য সাক্ষী হয়েছিলেন।
পাশাপাশি আমরা হৃদয় যন্ত্রণায় পুড়েছি, যতবার ভেবেছি, এমন বিশ্বমানের একজন শিল্পীর দীনতাকে সামনে রেখে প্রকাশ্যে রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করা হয়েছে! শিল্পী কি এতটা দীন হতে পারেন? কেন সাহায্য চাইতে হবে, শিল্পীর জন্য রাষ্ট্রের কোনো দায় নেই?
অমর এই গানের কবি জীবনভর তাঁর চিরচেনা দয়িতার কাছে রেখে দেওয়া মন ফিরে চাইতেন। কিন্তু ফেরৎ পাননি। পোড়া মনে সেই প্রেমময়ীর কথা বেজে ওঠত বলে ভুলে যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি তাঁর। সে এক অসহনীয় অনুপম জ্বালা বুকে নিয়েই হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগ পর্যন্ত ভালোবাসার মানুষটির কথা মনে রেখে লাকী আখন্দ গেয়েছিলেন:
আগে যদি জানিতাম তবে মন ফিরে চাইতাম
এই জ্বালা আর প্রাণে সহে না
ও মন রে...
কিসের তরে রয়ে গেলি তুই!
তারপর অনন্তরে চিরস্থায়ী পদচিহ্ন আঁকার আগে সেই প্রেয়সীকে উদ্দেশ্য করেই বলে গেলেন কি?
এই নীল মনিহার
এই স্বর্ণালি দিনে
তোমায় দিয়ে গেলাম
শুধু মনে রেখো...
স্মরণের জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে
শুধু আমায় ডেকো...
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই মহান শিল্পী ও একজন মুক্তিযোদ্ধা লাকী আখন্দ কাউসার আহমেদ চৌধুরীর কথায় গেয়েছিলেন, ‘স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে গানতো লিখেছি/ শতব্যাথা ভুলে তোমাকে মনে রেখেছি’। তাঁর দেশপ্রেম জাগানিয়া সুর ও সঙ্গীত আয়োজন এই গানটিকে সত্যিকারের প্রাণ দিয়েছিল। সঙ্গীতে নিবেদিতপ্রাণ এমন একজন শিল্পী গেল বছর নভেম্বরে ক্যান্সারের রক্তচক্ষুকে পাত্তা না দিয়ে গুলশানে হোটেল ওয়েস্টিনে ‘শিল্পীর পাশে ফাউন্ডেশন’ নামের ঢাকা উত্তর সিটি মেয়র আনিসুল হকের এক প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গিয়ে শেষবারের মতো মঞ্চে গান গেয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন, ঈশ্বরের কৃপা পেলে আরও ৩০-৪০ বছর দর্শক-শ্রোতাদের গান শুনিয়ে যেতে চান তিনি। কিন্তু কর্কটরোগ তাঁর দৃপ্ত আশাবাদকে থামিয়ে দিল বড় অকালে।
সংস্কৃতিমনা পরিবারের ছেলে হিসেবে মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই গানের জগতে প্রবেশ করেন তিনি। শিশুশিল্পী হিসেবে গান করেছেন বেতারে। টিভিতেও ছোটদের গানের অনুষ্ঠানে নিয়মিত শিল্পী ছিলেন তিনি। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই এইচএমভি পাকিস্তানের সুরকার এবং ১৬ বছর বয়সে এইচএমভি ভারতের সংগীত পরিচালক হিসেবে নিজের নাম যুক্ত করেন লাকী আখন্দ। জীবদ্দশায় ‘লাকী আখন্দ’, ‘আনন্দ চোখ’, ‘আমায় ডেকোনা’, ‘দেখা হবে বন্ধু’, প্রভৃতি শিরোনামে ৭টি অ্যালবামের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গীত প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। দেশের একালের প্রায় সব জনপ্রিয় শিল্পীই তাঁর সঙ্গীত আয়োজনে কণ্ঠ মিলিয়েছেন।
সঙ্গীতের বরপুত্র লাকী আখন্দের(১৮ জুন ১৯৫৬ - ২১ এপ্রিল ২০১৭) শারীরিক মৃত্যু হলেও তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর সুর ও গানে। আত্মমর্যাদাশীল এই শিল্পীর হাতে পুরো একটি প্রজন্ম আধুনিক বাংলা গান গাইতে শিখেছে। তাঁর সঙ্গীত ও সুরের মুন্সিয়ানায় দেখানো পথ ধরে বাংলা গানের জয়যাত্রা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু শিল্পীর জীবদ্দশায় তাঁর প্রাপ্য যথার্থ মর্যাদাটুকু তিনি পেয়েছেন এমনটা হলফ করে বলা যাবে না। স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের এই শিল্পীর রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বা স্বীকৃতি কি পাওনা ছিল না? আজ তাঁর অন্তিমযাত্রায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুরে সুর রেখেই বলতে পারি :
ডেকো না আমারে, ডেকো না, ডেকো না।
চলে যে এসেছে মনে তারে রেখো না ॥
আমার বেদনা আমি নিয়ে এসেছি,
মূল্য নাহি চাই যে ভালোবেসেছি,
কৃপাকণা দিয়ে আঁখিকোণে ফিরে দেখো না ॥
আমার দুঃখজোয়ারের জলস্রোতে
নিয়ে যাবে মোরে সব লাঞ্ছনা হতে।
দূরে যাব যবে সরে তখন চিনিবে মোরে--
আজ অবহেলা ছলনা দিয়ে ঢেকো না ॥
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন