এক্সট্রা কাভার
সফলদের তালিকায় মুস্তাফিজ
যাঁর হাতে লেখা হলো বাংলাদেশ ক্রিকেটে সাফল্যের নতুন ইতিহাস তিনি ইতিহাসের পাতা ওল্টানোর ছাত্র নন! এবং ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের এমন একটা জায়গা থেকে তাঁর উঠে আসা যে জায়গাটার ক্রিকেটীয় পরিচয় বলতে তেমন কিছু ছিল না। বরং সাতক্ষীরাকে মানুষ অনেক বেশি চেনে সিডর ও আইলা বিধ্বস্ত এক জনপদ হিসেবে। যে জনপদের মানুষের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ শক্ত হয়েছে চিংড়ি আর সাদা মাছের বিনিময়ে, বিদেশি ডলারের ওপর ভিত্তি করে। সে রকম একটা জায়গা এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভিতটাকেও শক্ত করে দিচ্ছে!
বাংলাদেশ ক্রিকেটের নতুন সেনসেশন মুস্তাফিজ আর সৌম্য সরকারের উঠে আসা সেই সাতক্ষীরা থেকে! বাংলাদেশ ক্রিকেটে যে জায়গাটা ছিল অনগ্রসর। সেই সাতক্ষীরাকে নতুনভাবে চিনতে শুরু করেছে ক্রিকেট মহল। আর ক্রিকেট বিশ্বে আবার বাংলাদেশকে নতুনভাবে চেনালেন সাতক্ষীরার উনিশ বছরের এক বাঁ-হাতি তরুণ।
ক্রিকেট বিশ্বও নতুনভাবে ইতিহাসের পাতা উল্টাতে শুরু করল। কারণ; ওয়ানডে ইতিহাসে অভিষেকের পর টানা দুই ম্যাচে পাঁচটি করে মোট দশ উইকেটে নিয়েছিলেন যে ব্রায়ান ভিট্টরি তাঁকে পেছনে ফেলে দিলেন মুস্তাফিজ। ৫+৫=১০ নয়; মুস্তাফিজ নিয়েছেন ৫+৬=১১ উইকেট। আর মুস্তাফিজের বাঁ-হাতের স্লোয়ার আর কাটারে ক্রিকেটীয় সিডরে বিধ্বস্ত ভারত। বাংলাদেশের কাছে প্রথমবারের মতো টানা দুই ম্যাচ হারলো সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের ছোট একটা গ্রাম থেকে উঠে আসা মুস্তাফিজ এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের নয়া ‘হিরো’। বিশ্ব ক্রিকেটে আলোচিত নাম।
মুস্তাফিজ- এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ক্রিকেটে এক নতুন নায়কের নাম। যাঁকে ঠিক শহুরে, শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, পেশাদার ক্রিকেটারদের গোত্রভুক্ত মনে হওয়ার আপাত কোনো কারণ নেই। বরং এই মুস্তাফিজকে দেখলে মনে হবে তিনি গ্রামের সহজ-সরল কর্মঠ তরুণদের প্রতিনিধি। যাঁরা পরিশ্রম আর সততা দিয়ে উঠে আসতে চান। কথাবার্তা, চাল-চলনে যাঁদের দেখে মনে হবে অসম্ভব পরিশ্রমী। আপদমস্তক খাটুনি করা তরুণ। যার মধ্যে সাফল্যের খিদে আছে। ঈশ্বরপ্রদত্ত কিছুটা প্রতিভা থাকার পরও যিনি মনে করেন, তাঁর পৃথিবী শুধুই পরিশ্রমের পৃথিবী। আর সেই পরিশ্রমটা করতে মুখিয়ে আছেন তিনি। তাই প্রথম দুই ম্যাচে ভারতের মতো তারকাসমৃদ্ধ শক্তিশালী ব্যাটিংকে গুঁড়িয়ে দিয়ে প্রেসের মুখোমুখি হয়ে বলতে পারেন- ‘আরো উন্নতি করতে হবে।’ অন্যরা যার স্লোয়ার আর কাটার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছেন অনেকটা ‘গড গিফটেড’ আর তিনি বলছেন, ‘প্র্যাকটিস করতে করতে হয়ে গেছে!’ আসলে নিজের সাফল্যের আপাত রসায়ন তাঁর কাছে ‘প্র্যাকটিস+প্র্যাকটিস+প্র্যাকটিস!’
প্রতিভার জোরে হোক আর প্র্যাকটিসের কারণে হোক মুস্তাফিজ এখন বাংলাদেশের নতুন বোলিং সেনসেশন! আবার সাফল্যের মাপকাঠি তাঁকে নতুন পেশাদার জগতের নির্মমতার মুখোমুখিও দাঁড় করিয়েছে। যে জগত শুধু পেতে চায়। নিতে চায়। আপনি সামান্য ব্যর্থ হলেই আপনাকে ছুড়ে ফেলতেও দ্বিধা করবে না! মুস্তাফিজ পা রেখেছেন সাফল্যের সেই নিষ্ঠুর জগতে! পরপর দুই ম্যাচে বাংলাদেশের কোনো বোলারের পাঁচ উইকেট নেই। অভিষেকে তো নয়ই। আর তাঁর এই প্রপ্তি তাঁকে দাঁড় করিয়েছে সমর্থকদের আগ্রাসী প্রত্যাশার মুখোমুখি! দুটো ম্যাচে পারলে তিন ম্যাচে কেন হবে না! এ রকম একটা অনুচ্চারিত বাক্য ঘুরপাক খাচ্ছে তাঁর চারপাশে।
প্রত্যাশার আগ্রাসন যাতে তাঁকে গ্রাস করতে না পারে সেজন্য অবশ্য তিনি পাশে পাচ্ছেন অভিভাবকের মতো অধিনায়ক মাশরাফিকে। যিনি বড় ভাইয়ের মতো আগলে রাখছেন তরুণ এই প্রতিভাকে। প্রত্যাশার চাপ যাতে ওর ওপর তৈরি না হয়, সে কারণে বাংলাদেশ অধিনায়ক পরিষ্কার বলে দিলেন, ‘আমি চাই ও ১০ বছর বাংলাদেশ দলকে সার্ভিস দিক। ওর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করা ঠিক হবে না। মিডিয়াকে সেটা বুঝতে হবে।’ প্রতিভাকে বিকোনো মিডিয়ার কাজ। পাশাপাশি প্রতিভাকে আগলে রাখার দায়িত্বও খানিকটা নিতে হবে মিডিয়াকে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে ‘আশা জাগানিয়া’ অনেক ‘আশার ফুল’এসেছে। আবার ঝরেও গেছে। মুস্তাফিজ যাতে আগে-ভাগে ঝরে না পড়ে সে দায়িত্বও সবাইকে নিতে হবে।
মুস্তাফিজ নিম্নবিত্ত এক পরিবার থেকে উঠে আসা তরুণ। উচ্চবিত্তের সরণিতে নিজেকে দেখার তাগিদ তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াবে এটা খুব স্বাভাবিক। ক্রিকেটার হিসেবেও তাঁর পথ চলা শুরু ক্রিকেটীয়ভাবে নিম্নবিত্ত এক দেশের হয়ে। যারা উচ্চবিত্তের দলে ঢোকার জন্য মরিয়া। মুস্তাফিজদের পারফরম্যান্স বাংলাদেশকে ক্রিকেটীয় নিম্নবিত্তের মানসিকতা ঝেড়ে ফেলতে শেখাচ্ছে। মুস্তাফিজ আরো অনেক দূর যাবেন। যাওয়ার ক্ষমতা তাঁর আছে। তবে ক্রিকেটে এমন অনেক নজির আছে- ইতিহাস গড়ে আবির্ভাব, আবার নীরবে, নিঃশব্দে, নিঃস্বের মতো প্রস্থান! ইতিহাস শুধু সফল মানুষটাকেই মনে রাখে। এবং তিনিই সফল যিনি সাফল্যের মাপকাঠিটা জানেন। সাফল্যের সংজ্ঞা অনেকে অনেকভাবে দেন। কিন্তু ক্রিকেটীয় সাফল্য একেবারেই গণিত নির্ভর। শুধু শুরু নয়। শুধু শেষও নয়। শেষ আর শুরুর বিয়োগফল= সাফল্য।
মুস্তাফিজুর রহমানের শুরুর সাফল্য নিয়ে অনেক কথাই হচ্ছে। হবে। এটাই মিডিয়ার কাজ। তারপরও মুস্তাফিজের জন্য বাড়তি কয়েকটা শব্দ লিখতে চাই। শুরুটা হলো। কিন্তু সাফল্যের সমীকরণে শেষের সংখ্যাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আজ সংবাদ মাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সব জায়গায় আপনার জয়জয়কার। ফেসবুকে এক তরুণী স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘মুস্তাফিজ তোমার নামে ভাই পূজা দেব! তুমি আবার ইন্ডিয়াকে ধসিয়ে দাও।’ বীরের পূজারি মানুষ। বাংলাদেশ ক্রিকেটে নয়া বীর মুস্তাফিজ। আপনাকে নিয়ে মাতামাতি হবেই। অন্যরা যা করার করুক; আপনি শুধু মাথাটা ঠাণ্ডা রাখুন। যেমন ঠাণ্ডা কথাবার্তা বললেন গত গোটা দুয়েক প্রেস কনফারেন্সে!
আপনার প্রতিভার বজ্রকণ্ঠ শারীরিক ভাষায় উচ্চারিত হোক প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের সামনে। মাঝখানের ২২ গজে। বাংলাদেশ দলের টুপিটা মাথায় দিয়ে মাশরাফি যখন আপনাকে বলেছিলেন; ‘টেন ইয়ার্স! কম করে হলেও ১০ বছর খেলতে হবে বাংলাদেশ দলে। সঙ্গে আরো একটা কথা বলেছিলেন কি না জানি না। প্রতিভাবান আর সফল বোলারের মধ্যে পার্থক্য অনেক। হ্যাঁ, সাতক্ষীরা আর ঢাকার দূরত্বের চেয়েও অনেক বেশি। প্রতিভাবান মুস্তাফিজকে সফল হিসেবেই শেষ করতে হবে ক্যারিয়ার। সেই সাফল্যের জন্য আপনার ফরমুলাটাই ঠিক। পরিশ্রম, পরিশ্রম এবং পরিশ্রম।
লেখক : ক্রীড়াসাংবাদিক ও কলাম লেখক