প্রতিক্রিয়া
দোনো হি তুঘলক!
যাত্রীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে রাজধানীতে চালু হয় ‘কম স্টপেজ’ বা ‘সিটিং সার্ভিস’ বাস। কিন্তু বাসমালিক ও শ্রমিকদের অনিয়মের কারণে সার্ভিসটা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিআরটিএ ও পরিবহন সমিতি।
রাজধানীর ভেতরে বাসে চড়ে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা আমার কম। সম্প্রতি বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব বেড়ে যাওয়ায় নিয়মিত বাসে চড়ছি। এতদিন সিটিং সার্ভিসের নানা অনিয়মের কথা শুনেছি, বাস্তবে দেখলাম ঘটনা তার চেয়েও সরেস। ভাড়া নিয়ে রীতিমতো তুঘলকি কাণ্ড চলছে! ফার্মগেট (খামারবাড়ি) থেকে খিলক্ষেত পর্যন্ত ‘ভিআইপি’ বাসে ভাড়া নিল ৫০ টাকা, ফার্মগেট (আনন্দ হল) থেকে খিলক্ষেতের ভাড়া ‘স্পেশাল’ নিচ্ছে ১৫, আর মহাখালী (রেলগেট) থেকে খিলক্ষেতের ভাড়া ‘গাজীপুর পরিবহন’ নেয় ২০ টাকা। আবার কাললী-কুড়িল ওভারব্রিজের এপার থেকে ওপার গেলেই ২৫ টাকা। মোহাম্মদপুর আড়ং স্ট্যান্ডে ফার্মগেটের এক যাত্রীকে দেখলাম ২০ টাকা নিয়ে ভিআইপি বাসের টিকেটঅলার পিছে ঘুরঘুর করছেন, কাউন্টার তাঁকে বাসে উঠতে দিচ্ছে না। অল্প দূরত্বের জন্যও যাত্রীকে দিতে হবে ফুল রুটের ভাড়া! এ রকম নানা ভোগান্তি, চিটিং, চাঁদাবাজি ও তুঘলকি বাস ব্যবস্থাপনার নাম ‘কম স্টপেজ’ বা ‘গেটলক সিটিং সার্ভিস’।
তীব্র যানজটের এই শহরে সিটিং সার্ভিস খানিকটা সময় বাঁচার স্বস্তি ও ভ্রমণের আরাম এনেছিল। আরাম হারাম হতেও সময় লাগেনি। বিনিময়ে প্রতিদিন কেবল বাড়তি ভাড়া নয়- চিটিং ও চাঁদাবাজির শিকার হওয়ার অনুভূতি নিয়ে গন্তব্যস্থলে যেতে অথবা বাসায় ফিরতে হয়। আবার কোনো কোনো এলাকায় যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, যাত্রী না তুলে সাঁই সাঁই করে একের পর এক বাস ছুটে যায় সিটিং সার্ভিসের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে। পরিবহন সেক্টরের লোকদের লোভ আর এসব খাসলতের কারণে শেষপর্যন্ত সার্ভিসটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তো, বিআরটিএ এখানে অনিয়ম বন্ধের কথা না ভেবে কেন সার্ভিস বন্ধ করাকে সমাধান মনে করছে!
পার্শ্ববর্তী দেশের কলকাতা শহরের পাবলিক বাসের আদব দেখার মতো। সেখানে যাত্রী প্রত্যাখ্যান করার নিয়ম নাই। অনেক বাসের গায়ে লেখাই থাকে- ‘দাদাভাইদের বলতে পারি/ হাত তুললেই থামবে গাড়ি’। যাত্রীর তোলার জন্য বাস অপেক্ষাও করতে পারে না। বাসে দাঁড়িয়ে থাকার জায়গা থাকলে যাত্রী তুলতেই হবে, নির্দিষ্ট স্টপিজে হাত তুললেই বাস থেমে যায়। তেমনি, যাত্রী তোলার সময়টুকু ছাড়া কোথাও বাস থেমে থাকে না। যাত্রী কম থাকলেও বাসগুলোকে অনবরত চলাচলের ওপর থাকতে হয়।
লোকাল বাস মানে যে ধীরগতির বাস নয়, নির্দিষ্ট এলাকায় চলাচলের জন্য নির্ধারিত বাস- এই সংস্কৃতিটা আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত না। এ ব্যাপারে বিআরটিএর কোনো মাথাব্যথা আছে বলেও মনে হয় না। বিআরটিএ শুধু একটাই কাজ করে, মাঝে মাঝে ভাড়া নিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি। কিন্তু গণপরিবহন ব্যবসায়ীরাও শেয়ানা, তারা যাত্রীদের সময় নিয়ন্ত্রণের চাহিদাকে পুঁজি করে ব্যবসা করছে, চালু করছে নিত্যনতুন সার্ভিস। সিটিং বন্ধ হলে কাউন্টার সার্ভিস বা এসি.. কিছু একটা করে তাদের ফায়দা তারা লুটছেই। ফলে আমপাবলিকের সময় বাঁচবে না, রাস্তায় রাস্তায় কাটাতে হবে জীবনের এক-চতুর্থাংশ কাল।
লোকাল ও সিটিং বাস ভাড়ার আলাদা চার্ট অ্যালাউ করে না বিআরটিএ। যাত্রীদের উপকারের কথা বিবেচনা করেই নাকি তারা এতদিন চুপ থেকেছে। সম্প্রতি সিটিং সার্ভিস নিয়ে অনিয়মের নানা অভিযোগ আসছে, সুতরাং ভাড়া নির্ধারণ ও চলাচলের সঠিক ব্যবস্থাপনার বদলে তারা সার্ভিসটাই বন্ধ করে দিচ্ছে। বলার অবকাশ নেই, দুজনেরই আদব তুঘলকি।
লেখক : কবি ও সংবাদমাধ্যমকর্মী