এক্সট্রা কাভার
ফতুল্লায় ‘একি হলো, কেন হলো.. কী যে হলো'
বৃষ্টি ঢাকায়। খেলা হলো না ফতুল্লায়! এটুকু শুনে কেউ বিভ্রান্ত হতে পারেন। কেউ হাসাহাসি করতে পারেন। তবে বিভ্রান্তির বা হাসাহাসির কিছু নেই। বৃষ্টি বিঘ্নিত ফতুল্লা টেস্ট ক্রিকেটের বাইরেও অনেক কিছু দিয়ে গেল!
টেস্ট ক্রিকেট থেকে ‘রেস্ট ডে’-কে বিশ্রামে পাঠানো হয়েছে অনেক আগে। কিন্তু ফতুল্লা টেস্টে সেও ফিরে এলো! ম্যাচের দ্বিতীয় দিন বাংলাদেশ-ভারত দুই দলই হোটেলে কাটাল। মাঠেই গেল না! কারণ বৃষ্টি। কিন্তু ফ্লাডলাইট যে টেস্টের প্রথম বল মাঠে গড়ানোর আগেই জ্বলে উঠেছিল, সেই টেস্টের দ্বিতীয় দিনের শেষ বিকেলে মাঠ যখন খেলার উপযোগী- সেই সময় দিনের খেলা পরিত্যক্ত! কারণ, জলাবদ্ধ ঢাকার জল চিরে সোনারগাঁও হোটেল থেকে ফতুল্লা পৌঁছাতে ক্রিকেটারদের যে সময় লাগবে তাতে খেলায় দিনের আলো বলে কিছু আর থাকবে না! অতএব ফতুল্লা টেস্টের দ্বিতীয় দিনটা বিশ্রাম হিসেবেই কাটিয়ে দিতে পারলেন ক্রিকেটাররা!
কিন্তু মাঠকর্মী, আম্পায়ার, ম্যাচ রেফারি, সাংবাদিক, টেলিভিশন ক্রু, ধারাভাষ্যকার, তাঁদের তো আর বিশ্রাম নেই। মাঠেই পড়ে থাকতে হলো তাঁদের। খেলা যেহেতু নেই, কিন্তু টেলিভিশনের অন এয়ার টাইম তো বিক্রি হয়েই আছে। তাই তাদের কিছু না কিছু দেখনোর চেষ্টা। কখনো কাভার ঢাকা মাঠ। কখনো বৃষ্টি ভেজা মানুষ। কখনো কমেন্ট্রি বক্সে কমেন্ট্রেটরদের খুঁনসুটি। টুকরো টুকরো অনেক কিছু দেখানোর চেষ্টা! সেই চেষ্টার মধ্যে কমেন্ট্রি বক্সে গান গাওয়া শেখানোর চেষ্টা হর্ষ ভোগলেকে। চেষ্টাটা করলেন ‘ওস্তাদ’ সঞ্জয় মাঞ্জেরেকার। সেই চেষ্টার কিছুক্ষণ আগে অবশ্য হর্ষ বলেছিলেন, ‘ঢাকায় বৃষ্টির কারণে খেলা বন্ধ রয়েছে!’ বৃষ্টিতে টেস্ট ভেসে যাওয়া একেবারে নতুন কিছু নয়। বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ থাকা ইংল্যান্ডে তো হর-হামেশাই হচ্ছে। আকাশ ভরা মেঘ নিয়েই তো ইংলিশ সামারে ক্রিকেট হয়। যে কারণে ইংরেজদের সম্পর্কে ক্রিকেট সার্কিটে একটা কথা চালু আছে, ওরা হাসতে জানে না। কারণ তাদের আকাশ হাসে না। তবে ভারতীয়রা এবার জুনে বাংলাদেশে টেস্ট খেলার সময় দিয়ে এ দেশের মানুষকে একটু মুচকি হাসার সুযোগ করে দিয়েছে! জুনে বাংলাদেশে বৃষ্টি হয় এটা সবার জানা। ভারতের অজানা সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তবু তারা জুনকেই বেছে নিল বাংলাদেশে টেস্ট খেলার জন্য। জুন ছাড়া তাঁদের হাতে কোনো সময় নেই বাংলাদেশে সিরিজ খেলার জন্য। কারণ, ক্রিকেট খেলার মুল সময়টা তারা বরাদ্দ রেখেছে ‘বিগ থ্রি’-র অন্য দুই সদস্য অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে সিরিজ খেলার জন্য। বছরের বাকি সময়ের কিছুটা নিউজিল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ জিম্বুাবুয়েকে ভাগ-বাটোয়ারা করে দেওয়া এবং অন্যরা মোটামুটি তাতেই খুশি। কারণ, ভারত মানেই ডলার। ভারতের বিপক্ষে সিরিজ মানে টেলিভিশন রাইটের দাম বেড়ে যাওয়া। কারণ, সোয়াশো কোটি মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় ভারতকেই দেখবে! ক্রিকেট যাই হোক, পয়সা এলেই অন্যরা খুশি।
সেই থিওরিতে বাংলাদেশেরও অখুশি হওয়ার কিছু নেই। বরং বাংলাদেশ একটু বেশি খুশি, কারণ টেস্টটা ড্র হয়েছে। বৃষ্টির সৌজন্যে নাকি মাঠে খেলে ড্র, সেটা তো আর স্কোরকার্ডে লেখা থাকবে না। এই ড্র-তে রেটিং পয়েন্টও কিছু বাড়ল বাংলাদেশের। আর ক্রিকেটটাকে ডলারের পাল্লায় মাপতে যারা অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে সেই ভারত এই ড্রয়ে আইসিসি র্যাংকিংয়ে এক ধাপ নেমে তিন থেকে চারে গেছে। তাতেও অবশ্য খুব বেশি হতাশার কিছু দেখছে না ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট। ম্যাচের শেষ দিনে তাদের টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রী যেমন ক্রিকেটারদের বলেছেন- তিনি খুশি যে ব্র্যান্ডের ক্রিকেট কোহলির নেতৃত্বে ভারত খেলল তাতে। এটা অব্যাহত রাখতে পারলে র্যাংকিংয়ে উপরের দিকে ওঠা বড় কঠিন কিছু হবে না।
রবি অবশ্য কথাটা ঠিকই বলেছেন। ভারত দারুণ আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলেছে, যেটুকু সময় তাঁরা মাঠে খেলার সুযোগ পেয়েছে। ম্যাচের আয়ু যদি বৃষ্টি কেড়ে না নিত তাহলে ফলাফলটা কি হতো তার একটা আভাস দিয়েছে ভারত বাংলাদেশকে ফলো অন করিয়ে। বাংলাদেশ যে ফলো অন করতে বাধ্য হলো সেটাতো আরেক ‘রবি’র কারণে। রবি চন্দন অশ্বিন। পাঁচ উইকেট নিয়ে তিনিই মুলত বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসকে খুব তাড়াতাড়ি ধসিয়ে দিলেন। আবার বাংলাদেশ যে স্বস্তি নিয়ে টেস্টটা ড্র করল সেখানেও হাত বাড়িয়ে দিলেন এক ‘রবি’। মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়ে ছিলেন তিনি পাঁচ দিনের টেস্টের প্রায় প্রতিদিনই।
রবির মুখ লুকানো আর আকাশের কান্নায় ম্যাচ শেষে একজনের গলা থেকে বেরিয়ে এলো কিশোর কুমারের সেই বিখ্যাত গান- ‘রাজকুমারী’ ছবিতে উত্তম কুমার যে গানে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন। ‘এ কি হলো, কেন হলো, কবে হলো, জানি না/ শুরু হলো, শেষ হলো, কি যে হলো, জানি না তো ...।’ গানটার হিন্দি সংস্করণও আছে। তবে ফতুল্লা টেস্টের শেষে এক মারাঠী বাংলা গানটাই গাইলেন। হ্যাঁ, সঞ্জয় মাঞ্জেরেকার বাংলায়ই গাইলেন। শুধু আধুনিক গান কেন, তিনি তো বাংলায় রবীন্দ্রসঙ্গীতও গেয়েছেন। বাংলা সিনেমার জন্য। ইমরান খান-ওয়াসিম আকরাম-ওয়াকার ইউনিস-মার্শাল-ওয়ালশ-অ্যাম্ব্রোজদের ফাস্ট বোলিং যিনি সামাল দিয়েছেন দ্রুপদী ঘরানার ব্যাটিংয়ে, রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁকে টানতেই পারে। কিন্তু ফতুল্লা টেস্ট সঞ্জয়কে দিয়ে গাইয়ে নিল কিশোর কুমারের বিখ্যাত গানটি। ওটাই আসলে ফতুল্লা টেস্টের থিম সং। ‘শুরু হলো, শেষ হলো, কি যে হলো, জানি না তো ... ...!’