তনু হত্যার এক বছর
মা-বাবাও একদিন কাঁদতে ভুলে যাবে
মহান স্বাধীনতার মাসে আমরা এমন এক অটুট বিশ্বাস নিয়ে বসে আছি যে, আর যাই হোক কুমিল্লার সোহাগী জাহান তনু হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হবে না। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বেস্টনির ভিতরে ঘটে যাওয়া এমন ঘটনা আড়াল করা কি রাষ্ট্রের শোভা পায়? আমাদের সেই দৃঢ় বিশ্বাসের এক বছর পূর্তি হলো আজ। এভাবে দিন পেরোবে, মাস পেরিয়ে আরো বহু বছর যাবে, একদিন ‘তনু’ নামটি আমাদের মগজের নিউরণ থেকে অলখে মুছে যাবে। তারপর হয়তো আমাদের পোক্ত বিশ্বাস আর অসাড় বোধে চিড় ধরবে। কালক্রমে সাংবাদিক সাগর-রুনির কাতারভুক্ত হবে দুঃখিনী তনু। অধিক শোকে পাথর ওঁর মা বাবা ভাইও একদিন কাঁদতে ভুলে যাবে।
সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্ণ হলো আজ। এ মামলার কোনো আসামি এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়নি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দু-একজন ধরা পড়লেও, তাদের শেষ গতি কী হয়েছে কেউ জানে না। এক বছরেও এ মামলার কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ অবস্থায় তনু হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে শঙ্কিত পরিবারের সদস্য ও প্রতিবাদকারীরা। তিন দফা তনু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদল করা হয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের ২৪ আগস্ট তদন্ত কর্মকর্তা বদল করে সিআইডির নোয়াখালী ও ফেনী অঞ্চলের সহকারী পুলিশ সুপার জালাল উদ্দীন আহমেদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, তদন্ত কর্মকর্তারা গেল এক বছরে শতাধিক সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই তাঁদের দায়িত্ব সেরেছেন। নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে শীতকালীন মহড়া থাকায় সামরিক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা যায়নি, তাই তদন্ত কাজ থমকে আছে। তবে সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা দায়িত্ব পাওয়ার পর কয়েকজনের সঙ্গে ডিএনএ মেলানোর উদ্যোগ নেন। গত বছরের ১৬ মে তনুর পোশাকে পাওয়া বীর্য পরীক্ষা করে তিনজনের ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছিল সিআইডি। তনুর পোশাকে পাওয়া তিনটি ডিএনএ প্রোফাইলের সঙ্গে সন্দেহভাজন কয়েকজন ব্যক্তির ডিএনএ মেলানো হলেও কোনো ফল আসেনি। এ প্রসঙ্গে অবশ্য তনুর মা আনোয়ারা বেগম জানিয়েছেন, যাঁরা সন্দেহভাজন, তাঁদের সঙ্গে বীর্য পরীক্ষার ডিএনএ প্রোফাইল না মেলালে মিলবে কেমন করে! মোটের ওপর এই হলো, তনু হত্যা তদন্তের সর্বশেষ অগ্রগতি। কিন্তু এই অগ্রগতি দিয়ে আসামি শনাক্ত করা আদৌ সম্ভব হবে- এমনটা কোনো খাটোবুদ্ধির লোকও বিশ্বাস করবে না।
টানাটানির সংসারে টিউশনি করে পড়াশোনা চালাতেন তনু। সেনানিবাসে নিজেদের কোয়ার্টার থেকে অনতিদূরের এক বাসায় টিউশনি শেষে ফেরার পথে যে পথ দিয়ে টিউশনির বাসায় যেতেন, সেই পথেই কুমিল্লা সেনানিবাসের ভিতরে গত বছর ২০ মার্চ রাতে একটি কালভার্টের নিচে মৃতদেহ পাওয়া যায় তনুর। ধারণা করা হয়, ধর্ষণ শেষে তাঁকে হত্যা করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। প্রতিবাদে সরব হয় সারা দেশের প্রগতিশীল সচেতন সমাজ। তনু হত্যার বিচারের দাবিতে ফুঁসে ওঠে দেশবাসী। মেয়েকে হারিয়ে মহাবিপাকে পড়েন তনুর ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের কর্মচারি বাবা ও তাঁর পরিবার। এখনো সেই শোক বয়ে বেড়াচ্ছে তারা। তার ওপর তদন্ত কর্মকর্তারা আশাব্যঞ্জক কর্মতৎপরতা দেখাতে না পারায় বিচারহীনতার শঙ্কায় ভুগছে পরিবারটি। এই অবস্থায় রাষ্ট্র কি দায়িত্ব নেবে অসহায় এই পরিবারটির শঙ্কা দূর করবার?
চাঞ্চল্যকর অনেক খুনখারাবি বা অপরাধ তদন্তে পুলিশের সফলতা আছে অনেক। কিন্তু ঠিক কোন প্রেক্ষিত বা কার অঙ্গুলিহেলনে তনু হত্যা তদন্তে ফল পাচ্ছে না পুলিশ তা কারোরই বোধগম্য নয়।
ভিক্টোরিয়া কলেজের একজন পরিশ্রমী ও মেধাবী শিক্ষার্থী, থিয়েটার কর্মী বা সঙ্গীত শিল্পী বহু গুণে গুণান্বিতা তনুর অকাল প্রয়াণে দেশের কিছু এসে যেতে না পারে, তদন্ত কর্মকর্তাদেরও কিছু এসে যেতে না পারে; ওঁর পরিবারের প্রতিটি সদস্য যে অসীম হাহাকার ও আর্তনাদ নিয়ে প্রতিটি ক্ষণ পার করছে, তা কি কারো ভাবনায় কড়াঘাত করবে না? ওঁর বাবা মায়ের স্বপ্ন ভেঙে দেওয়ার স্বাধিকার কি কারো থাকা উচিত?
পুরুষের কাছে নারী ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটলেই একশ্রেণির মানুষ সবার আগে নারীর চলন বা পোশাকের ওপর দায় চাপায়। কোনো কাপুরুষের অপরাধের সমালোচনায় তারা ভুলেও সরব হয় না। কিন্তু সোহাগী জাহান তনু নিজে পরিপাটি করে হিজাব পরতেন। চালচলনেও ছিলেন অসম্ভব রকমের শালীন। ধর্মচর্চায় ছিলেন একনিষ্ঠ। তবু কি লোলুপ পুরুষের নখর থেকে ওঁ রক্ষা পেলেন? আসলে নারীর ওপর শারীরিক আক্রমণকারীদের কাছে নারীর বয়স, চলন বা পোশাক বিষয় নয়, আসল সমস্যা পুরুষের পঁচে যাওয়া মস্তিষ্ক আর কুপ্রবৃত্তিতে। এ কথাই জোর দিয়ে বলার সময় এসেছে। নারীর দোষ ত্রুটি খোঁজা বাদ দিয়ে অপরাধী পুরুষের বিরুদ্ধে সব মানুষের একাট্টা হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
তনু হত্যার ঘটনাটি রাষ্ট্রীয় একটি বাহিনীর নিরাপত্তা বেস্টনির ভিতরে ঘটেছে। দেশের মূলধারার গণমাধ্যম বিষয়টি প্রথমদিকে এড়িয়ে গেছে। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে সরব হলে ঘটনাটি সবার নজর কাড়ে। এখন ওই মূলধারার গণমাধ্যমের ভূমিকাটিই যদি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা নিজেদের করে নেয়; তবে ধামাচাপা তত্ত্বটাই আলোর মুখ দেখতে পারে; সত্য কিছুতেই নয়।
মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। অপরাধ প্রবণতাও তার সহজাত। কাজেই সেই অপরাধী যদি কোনো নির্দিষ্ট বাহিনীরও হয়, তবে তাকে কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখা হবে? একজন ব্যক্তির অপরাধ তো সামষ্টিকভাবে বাহিনীর নয়। বরং দোষী প্রমাণিত হলে সেই ব্যক্তির উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিতের মাধ্যমে কোনো গোষ্ঠী বা বাহিনীর শুদ্ধতাই নিশ্চিত করা যেত।
আমরা চাই অপরাধী যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, অপরাধী কোনো স্বনামধন্য গোষ্ঠীর অঙ্গীভূত হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় এনে যথার্থ শাস্তি বিধান করা হোক। তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক তনুর মা আনোয়ারা বেগমকে চুপ থাকতে বলার নির্দেশনার মধ্য দিয়ে দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই।
স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার মাস উত্তাল মার্চ। লাখো শহীদের ত্যাগ আর সম্ভ্রম হারানোর যাত্রা শুরু হয়েছিল এই মাসেই। আর আমাদের এ কালের মার্চটা বিষণ্ণতায় ভরিয়ে দেয় তনুর অকাল প্রয়াণ। মার্চের সব শোক যেন তনুর প্রয়াণ কাব্যে মিলায়। তনু হত্যার সত্যিকারের বিচার নিশ্চিতের মাধ্যমে রাষ্ট্র কি পারে না দুঃখ জাগানিয়া মার্চটাকে ওঁর পরিবারের কাছে স্বস্তিকর করে তুলতে?
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন