মার্কসবাদের পরে কী?
১.
কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার (১৮৪৮) প্রকাশের ঠিক আগে প্রকাশিত হয়েছিল প্রিন্সিপালস অব কমিউনিজম নামে অ্যাঙ্গেলসের একটি লেখা। তাতে কমিউনিজমকে তিনি অভিহিত করেছিলেন প্রলেতারিয়েতের মুক্তির সংবাদ বলে।
প্রলেতারিয়েত বলে তিনি বুঝিয়েছিলেন শিল্পবিপ্লব সূচিত হওয়ার পরবর্তীকালের আধুনিক বৃহদায়তন শিল্পের শ্রমিক। ইশতেহারেও এ ধারণাকে অব্যাহত রাখা হয়। মার্কস ও অ্যাঙ্গেলস কর্তৃক ক্রমে বিকশিত হয়েছিল শ্রেণিসংগ্রাম ও শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্বের তত্ত্ব। এ ক্ষেত্রে একনায়কত্ব (dictorship) কথাটিকে গভীরভাবে বুঝে দেখার পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন আছে।
শ্রেণিসংগ্রাম ও শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্বের ধারণার মূলে আছে বস্তুবাদী দ্বন্দ্বদর্শন। এই ধারণা ও দর্শন অবলম্বন করে রাশিয়ায় (১৯১৭), চীনে (১৯৪৯) বিপ্লব সাধিত হয়। আরো কয়েকটি দেশে বিপ্লব সাধিত হয়। লেনিন, স্টালিন, মাও সেতুং প্রমুখের নেতৃত্বে অগ্রগতির ধারায় মার্কসবাদ কথাটি চালু হয় এবং তা কমিউনিজমের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। প্রশ্ন হলো মার্কসবাদ ও কমিউনিজম কি সমার্থক? শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্বে গোটা মানবজাতির পুনর্গঠন ও কমিউনিজম অভিমুখে পরিকল্পিত ঠিকানা ছিল মার্কসবাদের লক্ষ্য। এ কোনো মেয়াদি ব্যাপার ছিল না, এ ছিল অনন্ত ভবিষ্যতের ব্যাপার। মার্কসবাদকে ধর্মে রূপান্তর করার কথা ছিল না, কথা ছিল সব দিক দিয়েই বিকাশ রাখার। বিভিন্ন দেশের ন্যায় প্রতিষ্ঠাকামী লোকেরা গ্রহণ করেছিলেন কিংবা সমর্থন দিয়েছিলেন মার্কসবাদকে। বিভিন্ন দেশের মার্কসবাদী দলগুলোর মধ্যে অন্তর্বিরোধ ও আন্তবিরোধ ছিল। সাম্রাজ্যবাদী শান্তিগুলোর সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল মার্কসবাদী রাষ্ট্রগুলোকে এবং মার্কসবাদকে শেষ করে দেওয়ার। এর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপ (১৯৯১) ঘটে, চীন পর্যায়ক্রমে মার্কসবাদ ও মাও সেতুংয়ের চিন্তাধারা থেকে সরে যেতে থাকে, অপর মার্কসবাদী রাষ্ট্রগুলোর রূপ ও প্রকৃতিও বদলে যেতে থাকে।
০২.
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপের পর বিশ্বব্যবস্থা হয়ে পড়ে এককেন্দ্রিক। মানবজাতির সামনে ওয়াশিংটন থেকে প্রচারিত হতে থাকে unipolerism। এর মর্মে ছিল স্বাধীন বাজার অর্থনীতি ও অবাধ-প্রতিযোগিতাবাদ। এনজিও ও সিভিল সোসাইটির বিস্তার আরো বছর দশেক আগে থেকেই ঘটানো হচ্ছিল। দুর্বল রাষ্ট্রগুলোতে কার্যকর করা হচ্ছিল নিঃরাজনীতিকরণের অঘোষিত কর্মসূচি। দু-তিন বছর পরে unipolerism-এর স্থলাভিত্তিক করা হয় Globalization শব্দটিকে। এর কর্তৃপক্ষ রূপে সামনে আসে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, জি সেভেন (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি ও জাপান), ন্যাটো, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও জতিসংঘ। আর এসবের কেন্দ্রীয় পরিচালনায় থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মনে রাখতে হবে, বিশ্বায়ন কোনো কর্তৃপক্ষবিহীন ব্যাপার নয়। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় দুনিয়াব্যাপী পুঁজিবাদের ও অবাধ প্রতিযোগিতার কুফলসমূহ কমবর্ধমান রূপে দেখা দিচ্ছে। গণতন্ত্রকে গণবিরোধ রূপ দেওয়া হয়েছে। ওয়েলফেয়ার স্টেটের ধারণা ও কার্যক্রমে কোনো বিকাশ দেখা যাচ্ছে না। ওয়াশিংটনের আধিপত্যবাদী দুরভিসন্ধির মধ্যে ঘটে চলছে যুদ্ধের পর যুদ্ধ-বসনিয়ায়, হারজেগোবিনায়, আফগানিস্তানে, ইরাকে, লিবিয়ায়। দেখা দিচ্ছে সহিংসতা, সন্ত্রাস ও জঙ্গি কর্মকাণ্ড। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য পূর্ববর্তী যে কোনো কালের চেয়ে দ্রুততর গতিতে বেড়ে চলছে। তথ্যপ্রযুক্তি, জীব প্রযুক্তি ও অন্যান্য প্রযুক্তির কল্যাণে যে সুফল মানবজাতির জীবনে দেখা দেওয়ার কথা, প্রত্যেক রাষ্ট্রে তা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে সম্পদ ও ক্ষমতা কায়েমি-স্বার্থবাদী স্বল্প-সংখ্যক লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে। সর্বত্র অন্যায় বাড়ছে, ন্যায় কমছে।
এ এক সভ্যতার সংকট। এই সংকট সূচিত হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়েই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই সভ্যতার সংকট আরো গভীর ও ব্যাপক হয়। মার্কসবাদ অবলম্বন করে সভ্যতার সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু পৌনে এক শতাব্দী অতিক্রম করার আগেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপ ঘটে। তাতে সংকট আরো গভীরতর রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছে। মানুষ মানবীয় গুণাবলি হারিয়ে চলছে।
৩.
এ অবস্থায় মূল প্রশ্ন-মানবজাতির আদর্শগত অবলম্বন কী হবে? গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ-এসব আদর্শ যে রূপ ও প্রকৃতি নিয়ে আছে, তা দিয়ে কোনো উন্নতি হবে না। এসব আদর্শে আমূল নবমূল্যায়ন দরকার। বিশ্বায়ন তো সাম্রাজ্যবাদেরই উচ্চতর স্তর। যুক্তির মতবাদ সম্পর্কে আমার ধারণা আমার কোনো কোনো বইতে ব্যক্ত করেছি। এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করি।
আদর্শগত প্রশ্নে নতুন উদ্ভাবনের জন্য আলোচনা-সমালোচনা চালিয়ে যেতে হবে। বস্তুবাদী দ্বন্দ্বদর্শনকে পুনর্গঠিত ও বিকশিত করতে হবে। আদর্শগত সিদ্ধান্তের জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার পুনর্গঠনের কাজ বন্ধ রাখা যাবে না-পর্যায়ক্রমে কর্মসূচি ও কর্মনীতি অবলম্বন করে কাজ করে যেতে হবে। উন্নততর নতুন পৃথিবী সৃষ্টির জন্য যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদেরকে অবশ্যই ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক জীবনে নৈতিক অধ্যয়ন-অনুশীলন চালিয়ে যেতে হবে। সম্মিলিত নৈতিক অনুশীলন ব্যতীত যথার্থ ভালো কিছুই করা যাবে না। জাতিরাষ্ট্রগুলোকে ভেতর থেকে পুনর্গঠিত করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক ফেডারেল বিশ্ব সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
জাতির ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক ভিত্তি এবং জাতিরাষ্ট্র গঠনের জন্য বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য কিংবা বহুত্বমূলক সমন্বয় সম্পর্কে যথাসম্ভব পরিচ্ছন্ন ধারণা অর্জন করতে হবে। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ধারণা সমন্বিত করে জাতিরাষ্ট্রের জন্য জনগণের গণতন্ত্র বা শতভাগ মানুষের গণতন্ত্র বা সর্বজনীন গণতন্ত্র উদ্ভাবন করতে হবে। এই গণতন্ত্রকে আমি নয়া গণতন্ত্র বলে অভিহিত করি। নয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপ ও প্রকৃতি যথাসম্ভব পরিচ্ছন্ন রূপে উদ্ভাবন করে নিতে হবে। আর পর্যায়ক্রমে জনজীবনের সমস্যা সমাধানের ও উন্নয়নের কর্মসূচি প্রণয়ন অবলম্বন করে কাজ করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি কর্মসূচি অবলম্বন করতে হবে। নির্বাচিত আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিপরিষদ গঠন করতে হবে। নয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো রাজনৈতিক দল। দলের ঘোষণাপত্র ও সংবিধান দলের সকল সদস্য অবলম্বন করবেন এবং তা জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
নয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বহুদলীয় ব্যবস্থা থাকবে এবং বিভিন্ন দলের মধ্যে সম্মানজনক, সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা থাকবে। (আমার ‘গণতন্ত্র ও নয়া গণতন্ত্র’ বইতে এবং ‘আটাশ দফা : আমাদের মুক্তি ও উন্নতির কর্মসূচি’ পুস্তিকায় এ বিষয় আলোচনা আছে।)
জাতিরাষ্ট্রসমূহ থেকে প্রতিনিধি নিয়ে গঠন করতে হবে আন্তর্জাতিক ফেডারেল বিশ্বসরকার। জাতিরাষ্ট্রসমূহের কিছু ক্ষমতা চলে যাবে বিশ্বসরকারের কাছে। বিশ্বসরকারের কাছে একটি সেনাবাহিনী রেখে জাতিরাষ্ট্রসমূহের সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করা হবে। ফেডারেল বিশ্বসরকারের পরিসরে জাতিরাষ্ট্র, জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীয় ভাষা বিকাশশীল থাকবে। বিশ্বসরকারের কাজ হবে জাতিরাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি ও সংস্কৃতি সৃষ্টি, বিরোধ দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমে তার মীমাংসা করা, সংকট দেখা দিলে শান্তি স্থাপন করা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মানবজাতি এগিয়ে চলবে।
লেখক : অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক,বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়