পাঠকের কলাম
প্রশ্নপত্র ফাঁসে মেধার সর্বনাশ
প্রশ্নপত্র ফাঁস সাধারণ ও নিত্যনৈমিত্তিক এক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের পরীক্ষার ক্ষেত্রে এটি একটি সাধারণ ও অনিবার্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবছরের এসএসসি পরীক্ষার কয়েকটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের মধ্য দিয়ে ব্যাপারটি সবার নজরে আসে। গত বছর মেডিক্যাল ও ডেন্টাল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস অভিযোগের মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে সবার ক্ষোভ পরিলক্ষিত হয়েছে। সবাই তখন প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়নের তাগাদা দিয়েছিলেন কিন্তু একে বড় অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করেও শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে লঘুদণ্ডে!
টিআইবির এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পরীক্ষায় মোট ৬৩ বার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে । আবার অন্য একটি বেসরকারি গবেষণায় ২০১১-২০১৬ সাল পর্যন্ত মোট ১৯২ টি প্রশ্নপত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয় বরং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৯ সালে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে ফাঁস হয়।
২০১১ সাল থেকে এমন কোনো বছর নেই যে সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেনি পিএসসি পরীক্ষা থেকে শুরু করে সরকারি চাকরি এমনকি বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন সবই এ দেশে ফাঁস হয়েছে , ফাঁসকারীরা ধরাও পড়েছে কিন্তু হয়নি শুধু কোনো বিচার, তাই পরেরবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি! আমাদের আশংকা দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি না দেওয়ায় এ ধরনের অপরাধ ঘটছে বারংবার। আবার এই ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে অনেকে হয়েছে কোটিপতি! বিনা পারিশ্রামিক আর বিনা কষ্টে কোটিপতি হওয়া গেলে এবং কোনো শাস্তি না পাওয়া গেলে এ পথে মানুষ আসতে উৎসাহিত হবে না কেন?
সরকার ইতিমধ্যে ভিশন ২০২১ ও ভিশন ২০৪১ ঘোষণা করেছে আর এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে অবশ্যই মেধার স্বচ্ছ মূল্যায়ন আবশ্যক। আগামী দিনে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত আর উন্নত বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই সব জায়গায় প্রকৃত মেধাবীদের নিয়োগ দিয়ে এর কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। অন্যথায় সরকারের নেওয়া এসব ভিশন-মিশন ভেস্তে যেতে পারে। গত বছর মেডিক্যাল ও ডেন্টাল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করার সাহস পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস আর সেই প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা নেওয়া হলে সামনে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার প্রতি মনোযোগ কমে যাবে। তারা এর ওপর নির্ভর করে থাকবে আবার চাকরির ক্ষেত্রে এর মাধ্যমে মেধাবীদের অবমূল্যায়ন করা হবে।
চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে তবে তা সাজেশন আকারে ! অর্থাৎ মূল প্রশ্নপত্র ১০০টি হলেও সেখানে মূল প্রশ্নসহ দেওয়া হয়েছে ৪০০-৫০০টি প্রশ্ন। এটি এ জন্যই করা হয়েছে যাতে করে কেউ বিষয়টি জানতে পারলে সাজেশন বলে দায় এড়ানো যায়!
সাধারণত পরীক্ষার ১০-১২ দিন আগে প্রতিটি জেলায় এসব প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়, আর জেলা থেকে দুই-তিন দিন আগে উপজেলা পর্যায়ে পাঠানো হয় আর পরীক্ষার ঠিক কয়েক মিনিট আগে কেন্দ্রে পৌঁছায়। এসব প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় কীভাবে? রাঘব-বোয়ালরা এর সঙ্গে জড়িত নয় তো?
এক সময়ে নকল করাকে চুরি হিসেবে গণ্য করে এর বিরুদ্ধে প্রবল জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি সরকারও কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, তাই আজ বাংলাদেশের পরীক্ষার হলগুলো বলা চলে নকলমুক্ত। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস মুক্ত নয়। নকলকে চোরের সঙ্গে তুলনা করলে প্রশ্নপত্র ফাঁসকে ডাকাতের সঙ্গে তুলনা করতে হবে, কেননা এটি নকলের আধুনিক ও সবচাইতে কার্যকরী সংস্করণ। এই সংস্করণের মধ্য দিয়ে যেকোনো পরীক্ষার্থীই তাদের লক্ষ্য অর্জনে সামর্থ্য হবে, কেননা আগে নকল হলে নিয়ে গেলে তা পরীক্ষায় আসবে কি না, তার নিশ্চয়তা থাকত না, কিন্তু এখন তো পুরো প্রশ্নপত্রই আগে থেকে পাওয়া যাচ্ছে।
সবচেয়ে আশংকার জায়গাটা হলো কোমলমতি শিশুদের পরীক্ষা তথা পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা। এভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ফলে দেশের শিক্ষার্থীদের ক্লাস বিমুখ করে শিক্ষাব্যবস্থা যেমনিভাবে ধ্বংস হচ্ছে। জেএসসি, এসএসসি আর এইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ফলে অনেকে অংকে ও ইংরেজিতে এ+ সহ গোল্ডেন এ+ পেয়েছে কিন্তু এসব এ+ পাওয়া শিক্ষার্থীদের অনেকে গোল্ডেন শব্দটিও বানান করতে পারে না! এটি অবশ্যই জাতীয় শিক্ষা ও বুদ্ধির জগতকে ধ্বংসের প্রথম নির্দশন বলা যেতে পারে। বলা হচ্ছে গত দুই বছর এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস না হলে এসএসসি পরীক্ষার পাসের হার হতো ২৫-৩০%! আবার এসব শিক্ষার্থী আবার বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা চাকরির প্রশ্নপত্র পেয়ে পরীক্ষা দিবে এবং নিয়োগ পেলে দেশের কি অবস্থা হবে তা এখন ভাবার সময় এসেছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস না করে সবাই তাদের নিজের জ্ঞান, দক্ষতা দিয়ে পরীক্ষার হলে পরীক্ষা দেবে এবং সবাই তার নিজ যোগ্যতা দিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে যাবে এবং দেশকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে- এই প্রত্যাশা পুরো দেশবাসীর। আগামীতে আর যেন কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস না হয় সেদিকে লক্ষ রেখে কঠোর আইন করে এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ সর্বত্র গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের ওপর নজরদারি বাড়ালে, বিদ্যমান আইন সংশোধন করে কঠোর আইনের বিধান করে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করলে এ ধরনের অশুভ প্রতিযোগিতার দৌড় অনেকাংশে কমে আসবে ।
লেখক : প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, ফেনী সাউথ ইস্ট ডিগ্রি কলেজ