শীতবস্ত্র
শিশুর মতো সরলতায় মানুষকে ভালোবাসি
খুব একটা সুযোগ ঘটে না। আজ পেলাম। দুই মেয়েকে নিয়ে ভরদুপুরে লেপের তলায়। ঢাকায় আজ বেশ জাঁকিয়ে শীত নেমেছে। মোজা পরিয়ে লেপ জড়িয়ে শুয়ে আছি। ছোটটার নানা প্রশ্ন। আচ্ছা মা, শীত এলো কেন? শীত এলে সোয়েটার পরতে হয় কেন? এত সোয়েটার দোকানদার কোথায় পায়? এই ধাঁচের প্রশ্ন। তো বললাম, শোন একটা কষ্টের কথা বলি। যেসব মানুষ রাস্তায় থাকে, তাদের অনেকেরই সোয়েটার নেই। কাথা নেই। লেপ নেই। তারা শীতের রাতে ঝিম মেরে বসে থাকে। যখন আর সহ্য করতে পারে না, তখন আগুন জ্বালিয়ে নেয়। ওদের অনেক কষ্ট। আর এসব ফুটপাতে থাকা মানুষের সঙ্গে যে ছোট ছোট বাচ্চা থাকে, ওদের আরো অনেক কষ্ট। তাই আমাদের যাদের একটার বেশি লেপ আছে, তাদের উচিত গরিবদের দিয়ে দেওয়া।
ব্যস! এবার উঠে গেছে বিছানা ছেড়ে। মা, আমাদের একটার বেশি লেপ আছে। কম্বল আছে। তাহলে ওদের দিয়ে দিই।
এগুলো তো আমরা গায়ে দিই।
সবগুলো তো দিই না মা। ওদের দিই?
এগুলো তো নতুন। একটু পুরোনো হলে দিও।
না না, কাউকে পুরোনোটা দিতে নেই।
মহা বিপদ!!! এখন স্বার্থের চাপে কথা তো আর ফেরত নেওয়া যাচ্ছে না। উল্টো গুটি চাললাম। আচ্ছা কোনটা দিতে চাও?
বড় বুদ্ধির গুটি! চাললাম। তোমার এই ফুল দেওয়া ইয়োলো কালার কম্বলটা দিই?
চুপ মেরে গেল। মনে মনে ভাবলাম, যাক বাতিক ছুটবে। মনে মনে ক্রুর হাসি হাসলাম। কিন্তু না, ভাবনা পুরো ভুল।
একটু ভেবে নিয়ে বলল, ঠিক আছে বেবিকে দেবো এটা। আর আমি তোমার কাছে শুবো। একটু লজ্জা পেয়ে চেপে গেলাম নিজের দুমুখো অস্তিত্বের উপস্থিতি।
ঠিক আছে, কোনটা কোনটা দিতে চাও প্যাক করো।
ব্যস দুজনই লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়ল। আমার মায়ের ঘরে দুটো কম্বল, একটা একটু ভারী আর একটা পাতলা। তারা ভারীটা নিয়ে এসেছে। তাদের বাবার গায়ে দেওয়া মেরুন কালারের কম্বল ভাঁজ করে রেডি করেছে। বলছে, বাবা তো এটা বেশি পরে না। তাই এটাও দিয়ে দিতে হবে। সিঙ্গেল একটা লেপ আছে। গেস্ট এলে দিই। সেটা আর লাগবে না। গেস্ট আসতে বারণ করতে হবে জানিয়ে দিল। বড় একটা লেপ রেখে বাকিটা টেনে নামাল। আমরা সবাই একসঙ্গে শুলে বাকিগুলোর দরকার নেই। ছোট ছোট চারটি হাত চালাতে চালাতে সিদ্ধান্তও জানিয়ে দিল।
চুপচাপ দেখলাম। শুনলাম। বললাম, শুধু লেপ-কম্বল দিলে কী হবে? ওদের তো শীতের জামাও নাই।
আচ্ছা মা, কয়েকটা জামাও দিই।
এবার উৎসাহে হাওয়া লাগল। যার যার ড্রয়ার খুলে সেই যে বাছাই করছে তো করছেই। দুজনে মিলে ১৭টা বাছাই করেছে দিয়ে দেওয়ার জন্য। আর একটু পরপর বলছে, মা তুমি না সুপার হিরোদের মতো।
ওদের উৎসাহ দেখে এখন আমার একটু খারাপ লাগছে। সত্যি কেন আমি সুপার হিরোদের মতো নই??? এত সহজ করে আমি কেন ভাবতে পারছি না। একাধিক না রেখে কেন দিয়ে দিতে পারছি না, যখন আমি জানি কত মানুষ এই শীতে কষ্ট করছে। কত বাচ্চা ঘুমোতে পারছে না।
ওদের বাছাই করে রাখা সব শীতবস্ত্র হয়তো এখনই দিয়ে দিতে পারব না। কিন্তু গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে ভেবে, মানুষকে ভালোবাসতে শিখছে আমার সন্তানরা।
আমার মতো একটি পরিবার যদি অন্য আর একটা অসহায় পরিবারে পাশে দাঁড়াই তো সম্ভব এই সুন্দর দেশকে আরো সুন্দর করে সাজিয়ে নেওয়া।
চলুন না, একটা হাত ধরি ভালোবাসায়। আজকে রাতে যে শিশুটি শীতে কাতরাতে কাতরাতে ঘুমাবে, চলুন ওর গায়ে নিজের সন্তানের জামাটা তুলে দিয়ে আসি সন্তানসম করেই। আমাদের সন্তানরা আমাদের মাধ্যমেই দিতে শিখুক। জানুক, মানুষের জন্য বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে ভালো মানুষ হয়ে ওঠার সুখ। ওদের দিয়ে বদলে নেই চারপাশকে। এবং চলুন না বদলে যাই।
আর চলুন, শিশুর মতো সরলতায় মানুষকে ভালোবাসি। মানুষ মানুষের জন্য... এবং সন্তানের কাছে সকল জড়তা কাটিয়ে হয়ে উঠি সত্যিকারী সুপার হিরো ।
লেখক : তরুণ উদ্যোক্তা, লাকী আইডিয়াবিডি ডটকম।