পাঠকের কলাম
টাইগারদের হারের পর ময়নাতদন্ত
সাফল্যের স্রোতে ছিল বাংলাদেশ। ‘বাংলাওয়াশে’র জবাব ‘কিউইওয়াশ’ দিয়েই যেন দিল তারা। তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের সবকটিতেই তাই টাইগার বাহিনীর হার।
২০১৪ সালের ২৬ আগস্ট থেকে ২০১৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ঘরের মাঠে খেলেছে। দীর্ঘ এই সময়ে একবারও ধবলধোলাই তথা হোয়াইটওয়াশের কালিমা লাগেনি মাশরাফিদের গায়ে; বরং এ সময়ে প্রতিপক্ষকে বেশ কয়েকবারই ধবলধোলাইয়ের স্বাদ দিয়েছেন তামিম-সাকিবরা। সে তালিকায় নিউজিল্যান্ডও ছিল। এবার যেন কিউইরা সেই ধবলধোলাইয়ের ‘প্রতিশোধ’ কড়ায়গণ্ডায় নিল।
বাংলাদেশ যে গতিতে এগোচ্ছিল, তাতে হুট করে এই ছেদ কেন? সেই আড়াই বছর আগে যেভাবে হতাশার আচ্ছাদনে মোড়া থাকত বাংলাদেশ দল, এবার যেন সেই হতাশা ঘিরে ধরেছিল দলকে।
কেন এই হতাশা? কেন অসহায় আত্মসমর্পণ? কিছু বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে।
প্রথমত, গোটা সিরিজে সিনিয়রদের যেভাবে দায়িত্ব নেওয়ার কথা, সেভাবে নিতে পারেননি তাঁরা। বিশেষ করে ব্যাটিং আমাদের ডুবিয়েছে লজ্জায়। পুরো সিরিজে মাহমুদুল্লাহ চরমভাবে ব্যর্থ, তিন ম্যাচে রান মাত্র ৪! ইমরুল (১১৯) ও তামিম (১১৩) ছাড়া টপঅর্ডারের ব্যাটসম্যানদের রান উল্লেখ করা মতো নয়। সিরিজে সাকিব ৮৪, সাব্বির ৭৩, মোসাদ্দেক ৬৪, নুরুল হাসান ৬৮ রান করেছেন। অথচ একেকটা ম্যাচেই এ রকম রান করার সক্ষমতা আমাদের ব্যাটসম্যানদের রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ব্যাটসম্যানরা ব্যর্থ তো হয়েছেনই, তার ওপর ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে হুড়মুড়িয়ে একসঙ্গে সবাই সাজঘরে ফেরার ‘প্রতিযোগিতা’ করেছেন। একেকটা ম্যাচে ব্যাটিংয়ে যখন আশা জাগছে, তখনই ব্যাটসম্যানরা যেন ‘আত্মাহুতি’র মিছিলে যোগ দিয়েছেন। প্রয়োজনের সময় কেউই বুক চিতিয়ে লড়তে পারেননি।
তৃতীয়ত, আমাদের বোলিং ছিল লাগামছাড়া। বাংলাদেশের পক্ষে সিরিজে সর্বোচ্চ ৫ উইকেট নিয়েছেন সাকিব। গড়ে প্রতি ওভারে রান দিয়েছেন ৬.০৩ করে। তানভীর হায়দার ৬.৭০, সাব্বির ৬.৬৬, তাসকিন ৬.০০, মোসাদ্দেক ৬.০০ করে রান দিয়েছেন ওভারে। শুধু মুস্তাফিজ (৪.৮৬) ও মাশরাফির (৫.৪০) বোলিংই ছিল নিয়ন্ত্রণে।
চতুর্থত, নিউজিল্যান্ড সফরে দলে থাকা সত্ত্বেও রুবেল হোসেনকে না খেলানো। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের সেরা ওয়ানডে বোলার রুবেল। কিউইদের বিপক্ষে ৯ ম্যাচের রুবেলের উইকেট ১৭টি। গড় ২২.৩৫, ইকোনমি ৫.০১, সেরা ৬/২৬। নতুনদের অভিষেক না ঘটিয়ে রুবেলকে খেলানো হলে ভালো ফল হয়তো আসতে পারত।
পঞ্চমত, সিরিজে ব্যর্থতার অন্যতম কারণ টিম ম্যানেজমেন্টের অপরিণামদর্শিতা। বিদেশের মাটিতে ২২ জন খেলোয়াড়ের বিশাল বহরকে বয়ে বেড়ানো হচ্ছে। এই বিলাসিতা জরুরি ছিল? কন্ডিশনের ধোয়া তুললে বলতে হয়, কন্ডিশন কি লাভ দিল বাংলাদেশকে? এ ছাড়া নিউজিল্যান্ডের মতো কঠিন কন্ডিশনে তিনজন ক্রিকেটারের অভিষেক ঘটানো চরমতর বাজে সিদ্ধান্ত। তরুণ ক্রিকেটারদের মনোবল ভেঙে দিতে, তাঁদের আস্তাকুঁড়ে ফেলতেই এ রকম সিদ্ধান্ত। বিশেষ করে তানভীর হায়দারকে আর কবে দলে দেখা যাবে, সেটা নিশ্চিতভাবেই কোটি টাকার প্রশ্ন! তাঁর ক্যারিয়ার নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কারো নেই। তানভীর খারাপ করেছেন, কিন্তু তিনি জোর করে দলে ঢোকেননি। এমন কঠিন কন্ডিশনে তাঁকে দলে রাখাটাই হয়েছে ভুল।
ষষ্ঠত, হাথুরুসিংহ ‘একনায়ক’ হয়ে উঠেছেন বলে মনে হচ্ছে। যা মন চায়, তাই করছেন। যাকে ইচ্ছা দলে নিচ্ছেন, তারপর আবার ছুড়ে ফেলছেন! তরুণ ক্রিকেটারদের এভাবে ধ্বংস করতে পারেন না তিনি। বোর্ড যদি মনে করে, হাথুরুসিংহের আমলে সাফল্য আসছে, তাই তাঁকে কিছু ‘বাড়তি সুবিধা’ দেওয়াই যায়, তবে ভুল করবে। মনে রাখা দরকার, হাথুরু একজন কোচ মাত্র। মাঠের মধ্যে ক্রিকেটাররাই খেলেন। নিজের যোগ্যতা, দক্ষতা দিয়েই তাঁরা সাফল্য পান। সাফল্যে ভাসে দল। এ ক্ষেত্রে কোচের ভূমিকার চেয়ে দলগত ভূমিকা ও দলের অধিনায়কের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে পায়।
গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে হুট করে দলে সাকলাইন সজীব আর শুভাগত হোমকে ডাকলেন হাথুরুসিংহে। সেই সজীব আর শুভাগত কোথায় এখন? সর্বশেষ ইংল্যান্ড সিরিজে মোশাররফ রুবেলকে দলে ডাকলেন। কদিন যেতে না যেতেই ইনিও ‘নাই’ হয়ে গেছেন! এবার তানভীর হায়দারও হয়তো অন্তরালে চলে যাবেন। এভাবে একের পর প্লেয়ারকে হুটহাট ডেকে এনে কদিন পরই ছুড়ে ফেলা কিসের ইঙ্গিত দেয়? কেন এভাবে উদীয়মান প্লেয়ারদের মনোবলকে বিধ্বস্ত করে দিচ্ছেন হাথুরুসিংহ?
কন্ডিশনের সঙ্গে ‘খাপ খাওয়ানোর’ কথা বলে হাথুরুসিংহ নিউজিল্যান্ড না গিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে গেলেন অস্ট্রেলিয়ায়। অথচ দুই দেশের আবহাওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন! তবে কি নিজের পরিবারের সঙ্গে কয়টা দিন কাটানোর ছুঁতোয় কন্ডিশনিং ক্যাম্পের ধোয়া তোলা?
মাশরাফিরা লড়াকু। মাশরাফিরা এত সহজে হার মেনে নেবেন না। এক ওডিআই সিরিজে হারে কিছুই হবে না। মাশরাফিরা ফিরবেন আপন গতিতেই। কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের চোখ বোলানো জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক ও রম্য লেখক।