প্রাথমিক শিক্ষা
বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ চাই
শক্তিশালী এবং স্বনির্ভর জাতিগঠনে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার ভূমিকা ও কার্যকারিতার কথা সর্বজনবিদিত, এই স্তরে কাঙ্ক্ষিত এবং যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ জরুরি। এ জন্য সর্বজনীন শিক্ষা-ব্যবস্থার বাস্তবায়ন ছাড়া কোনো বিকল্প যেমন নেই, প্রয়োজনীতা রয়েছে তেমনি শিক্ষাকে গণমুখী এবং জীবনঘনিষ্ঠ করারও।
প্রায়ই আমাদের শিক্ষার গন্তব্য এবং এর কাঠামো নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ এবং নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে দেখা যায় চারপাশে, প্রচলিত যে শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আমরা পরিচিত হয়ে উঠেছি, বিশেষ করে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের কথা যদি ধরা হয়, তার ভেতর-বাহির, সামগ্রিক অবয়ব এবং পাঠদানের পদ্ধতি কি অন্তসারশূন্য! মানসম্মত শিক্ষাকে অধিকতর কার্যকর এবং ফলপ্রসূ করতে প্রাথমিক স্তরে তিনটি বিষয়কে সামনে রাখা অত্যন্ত জরুরি।
প্রথমত : পাঠ্যসূচি প্রণয়নে শিশুদের মেধা ও মননের বিকাশ, ধারণক্ষমতা এবং প্রয়োজনীয়তাকে প্রাধান্য দেওয়া।
দ্বিতীয়ত : সম্মানিত শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যকার সম্পর্ককে মধুর ও উপভোগ্য করার ব্যবস্থা এবং
তৃতীয়ত : সনদনির্ভরতা কমিয়ে এনে প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহ এবং সামগ্রিক পরিবেশকে শিশুবান্ধব করে তোলা।
শিক্ষার সঙ্গে আনন্দের সংযোগের কথা আজকের দিনে নতুন নয়, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ থেকে জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ আমাদের মহান পথ প্রদর্শকরা সবাই ‘শিক্ষার সহিত আনন্দ’র প্রতি জোর দিয়ে চাকরি এবং সনদনির্ভরতাকে অগ্রাহ্য করেছেন। সমকালীন বাংলাদেশে প্রাথমিকস্তর পড়ুয়াদের জন্য যে পাঠ্যসূচি এবং কায়দা-কানুন চালু রয়েছে তা মোটেও সহজবোধ্য ও আনন্দদায়ক তো নয়ই বরং কিছু কিছু পদ্ধতি জীবনের মূলধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিকও। খেলারছলে বা খেলাধূলার সঙ্গে জীবন ও সমকালের পাঠ যে নেওয়া সম্ভব এ কথা আমাদের দেশের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্তারা এবং পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা মহাশয়রা যেন বিস্মৃত হয়েছেন। সহজ, সুন্দর ও অধিকতর সহনীয় পদ্ধতির বিপরীতে আমরা আবিষ্কার করেছি কিছু কঠিন, দুর্বোধ্য ও এমন সব নয়া পদ্ধতি যা জীবনের মূল ধারার প্রতি ভ্রুক্ষেপহীন এবং পাঠাভ্যাস গড়বার পক্ষে সহায়ক নয়।
সমকালীন বাংলাদেশের প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের ছোট বয়সের শিক্ষার্থীদের যে পরিমাণ পড়ার চাপ সেটিকে ‘পড় অথবা মর’ অবস্থার সঙ্গে তুলনা চলে, এমনকি এসব ছোট্ট শিশুরা নিজেদের বই-খাতাসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ শারীরিকভাবে বহন করতেও অক্ষম, যা আমরা অবিবেচকের মতো তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছি। দেশের শতভাগ শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনতে শিক্ষা ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিষয়াদিকে সহজবোধ্য এবং আরো জীবনঘনিষ্ঠ করার বিকল্প নেই। দেশের ৮০ ভাগের বেশি শিক্ষার্থী গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে পাঠ নেয়, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে সিংহভাগ নজর দিতে হবে গ্রামের পাঠশালাগুলোতে। আজকের দিনের গ্রামের বিদ্যালয়গুলোর সার্বিক চিত্র ভয়াবহ। সংক্ষিপ্তভাবে একটি বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদন এখানে তুলে ধরা হলো। গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এক-তৃতীয়াংশ স্কুলে ছাদ নেই, ৪২ শতাংশ স্কুলে নেই বসার জায়গা এবং বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছে ৬৯ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে এত ভগ্নদশায় রেখে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সহজসাধ্য নয়। প্রতিবেশী দেশ ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভারতে শিক্ষায় বরাদ্দ আমাদের চেয়ে বেশি এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার মান অনেকটাই নিশ্চিত করেছে উল্লেখিত দেশগুলো। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ভারতে প্রাথমিক শিক্ষার ভীত শক্তিশালী ও গুণগত মানের পরিবর্তনের জন্য বরাবরই সোচ্চার রয়েছেন, বিভিন্ন সময় বক্তব্য-বিবৃতি, সেমিনার ও নানা ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা দিয়ে তিনি যথাযথ প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের বিষয়ে জোড় তাগিদ অব্যাহত রেখেছেন।
প্রসঙ্গত দেশের মানবসম্পদকে দক্ষ জনশক্ষিতে রূপান্তর করতে মাধ্যমিক স্তর থেকে কারিগরি ও ব্যবহারিক শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা এবং একইসঙ্গে এই ব্যবস্থাকেও যুগোপযোগী করাও আবশ্যক। এ ছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিতে কিছু আবশ্যক পদক্ষেপ রয়েছে যেগুলো বাস্তবায়নে সরকারকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। যেমন, শিক্ষা-বাজেট বৃদ্ধি এবং এর সুষ্ঠু তত্ত্বাবধান ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমকে গতিশীল রাখা। ভৌত ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং শিক্ষা উপকরণ নাগালের মধ্যে রাখা। প্রতিটি স্কুলে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ বিজ্ঞানাগার ও প্রয়োজনীয় বইসহ গ্রন্থাগারের ব্যবস্থা করা, শতভাগ বিদ্যালয়কে বিদ্যুতের আওতায় নিয়ে আসা।
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় মানবিক এবং নৈতিক শিক্ষা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রাথমিক পর্যায় থেকেই মানবিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়ার বিকল্প নেই। নিজস্ব সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের গড়ে তুলবার দায়িত্ব আমাদেরই। আর এই সমগ্র আয়োজন সম্পন্ন করতে প্রয়োজন সুপরিকল্পিত তত্ত্বাবধায়ন ও নজরদারি। সামগ্রিক অর্থে শিক্ষা এবং দেশকে গড়ে তুলবার দায়িত্ব ও কর্তব্য আমাদেরই, আর তা সমষ্টিগত, সবাই মিলে এটি সম্পন্ন করতে হবে, এতে অসফল হলে সামনে থাকে সার্বমানবিক হাহাকার ও ব্যর্থতা।
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন