মানুষ যদি সে না হয় মানুষ!
আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এর পেছনের কারণও আমাদের অজানা নয়। চালকের ভুল, অসতর্কতা, যানবাহনগুলোর বেপরোয়া প্রতিযোগিতা, অবৈজ্ঞানিকভাবে সড়ক নির্মাণসহ নানাবিধ কারণেই এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। ফলে সড়কে যেমন অকালে মানুষ বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে, তেমনই অনেকে চিরতরে পঙ্গুও হয়ে যাচ্ছে। ফলে বেঁচে থেকেও কাটাতে হচ্ছে যন্ত্রণাময় জীবন। অথচ আমাদের পরিবহণ সেক্টরের সাথে জড়িত মানুষেরা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সাধারণ মানুষ সবাই মিলে চেষ্টা করলে দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভবপর হতো। সে চেষ্টা যে নেই সেটা বলছি না। তবে, তার প্রতিফলন বাস্তবে আমরা সেই অর্থে দেখতে পাচ্ছি না।
আমাদের দেশে অনেক সময়ই দুর্ঘটনাকে নিছক আর দুর্ঘটনা বলে মনে হয় না। মাঝেমধ্যে চালকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখে মনে হয় কোথায় আছি আমরা! আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অনেক সময় তাঁরা এসব দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন। অর্থাৎ তাঁরা জেনেবুঝেই এসব দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছেন। অথচ তাঁরা যদি একটু সতর্ক হতেন, তাহলে এসব দুর্ঘটনা সহজেই এড়ানো সম্ভবপর হতো। রাস্তায় যানবাহনের বেপরোয়া গতি দেখলে অনেক সময় মনেই হয় না গাড়িটি কোনো সুস্থ, বিবেকসম্পন্ন চালক চালাচ্ছেন।
আগেও নানামাত্রিক ঘটনায় আমরা চালক ও হেলপারের অমানবিক হওয়ার উদাহরণ দেখেছি। গাড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া, চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণের মতো বর্বরতারও খবরও পত্রিকায় দেখেছি। তবে সাম্প্রতিক একটা ঘটনা দেখে বেশ অবাকই হয়েছি। একে অমানবিকতা বা নিষ্ঠুরতা যা-ই বলি না কেন, তা কমই বলা হবে। পত্রিকায় দেখতে পেলাম এমন একটা হেডলাইন! “সাভারে দুই চালকের রেষারেষিতে অ্যাম্বুলেন্সে শিশুর মৃত্যু, গ্রেপ্তার ৩”। ভাবা যায়!
ঘটনাটি এমন, গত মঙ্গলবার বিকেলে ক্যানসারে আক্রান্ত শিশু আফসানাকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি মহাখালী ক্যানসার হাসপাতাল থেকে গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধায় ফিরছিল। পথে অ্যাম্বুলেন্সটি একটি মাইক্রোবাসকে ওভারটেক করে। পরে অ্যাম্বুলেন্স আশুলিয়ার বাইপাইলে পৌঁছালে মাইক্রোবাসটি সামনে এসে তার গতিরোধ করে। ওভারটেকের কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে মাইক্রোবাসের চালক নজরুল নেমে অ্যাম্বুলেন্সের চালক মারুফ ও সহকারী ইমনকে মারধর শুরু করেন। একপর্যায়ে অ্যাম্বুলেন্সের চাবিটিও ছিনিয়ে নেন নজরুল। পরে অনুনয়-বিনয় করেও চাবিটি ফেরত দেননি। এমন এক অবস্থায় শিশুটি অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে মারা যায়। পুলিশি তৎপরতায় অভিযুক্ত চালক ও তার সহযোগীরা গ্রেপ্তার হয়েছে! আর সে সূত্রেই এমন নির্মম ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ায় আমরা তা জানতে পেরেছি।
এমন ঘটনা আসলে অবাক হওয়ার মতো, ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। দুই চালকের রেষারেষিতে অসংখ্য দুর্ঘটনার খবর আমরা দেখতে পাই। দিন দিন এসব কমার কথা হলেও কমছে কই! বরং অমানবিকতার নিত্যনতুন রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি। কে কাকে অন্যায়ভাবে ওভারটেক করল, সেটা নিয়ে অনেক সময় পরিবহণ শ্রমিকদের মধ্যে তর্কবিতর্ক হতে দেখেছি। আবার নিজেরাই সেটা মীমাংসাও করে নিয়েছে। তবে অ্যাম্বুলেন্সের চাবি ছিনিয়ে নিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী ক্যানসারে আক্রান্ত এক শিশুকে যে এভাবে জেনেবুঝেও জেদ করে ঠাণ্ডা মাথায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া যায়, তা মনে হয় কল্পনাও করা যায় না! ভুল হলে তা দুই চালক করেছেন! সেটার দায় কেন যাত্রীদের নিতে হবে? কেন তাদের জিম্মি করতে হবে? এসব তো স্বাভাবিক কোনো সুস্থ মানুষের কাজ নয়! জেনেবুঝে যাঁরা এসব করে থাকেন, তারা কি মানুষ?
এমন দুঃখজনক খবর পড়ার পরে মনেই হতে পারে, এরা খারাপ মানুষ। এদের হাতে যাত্রী, পথচারী কেউই নিরাপদ নন।পরিবহণ সেক্টরে এমন মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে, দুর্ঘটনার সংখ্যাও তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়বে। ফলে জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থেই এসব বিষয়ে কঠোর হতে হবে। চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। তাঁদের সঠিক মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। কারণ, পকেটে টান পড়লে মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধি লোপ পায়; এটা চিরায়ত সত্য। কোনো পেশায় যদি সঠিক মজুরি না থাকে, সম্মান না থাকে তাহলে সে পেশায় যাঁরা থাকেন, তাঁরা মানবিকতার চর্চা করবেন না, এটাও চরম সত্য। ফলে চালকদের মানবিক করে গড়ে তুলতে হলে তাঁদের জবাবদিহিতার পাশাপাশি সম্মানজনক মজুরিরও বন্দোবস্ত করতে হবে। না হলে এ সেক্টরে জড়িত মানুষজনের কাছ থেকে হয়তো আমরা খুব ভালো কিছু আশা করতে পারব না। তাতে করে এমন অমানবিক ঘটনা বা দুর্ঘটনা তো কমবেই না, বরং বাড়তেই থাকবে। আর জীবন দিয়ে তার মূল্য চুকাতে হবে আমজনতাকেই!
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলোজ, সাভার