করোনার অভিজ্ঞতার আলোকে বাজেট ও কাঠামোর সংস্কার
কোভিড-১৯ বা নভেল করোনাভাইরাস এই শতাব্দীর একটি বিশ্ব-মহামারি বা বিশ্ব-মহাদুর্যোগ, যা-ই বলি না কেন বিশ্বব্যাপী এই করোনাভাইরাসের বিভীষিকাময় বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব বেড়েই যাচ্ছে। প্রবাসীরাও সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে এবং তাদের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা কম নয়। এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা এই পরিস্থিতির জন্য নিজেরা দায়ী নয়। তদুপরি আক্রান্তরা বিভিন্নভাবে দুর্ব্যবহার ও অবজ্ঞার শিকার হচ্ছে এবং অনেকে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য গোপন করছে। আবার সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের বিভ্রান্তি তো আছেই।
তবে সারা দেশে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, সামরিক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মাঠপর্যায়ে এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনী পরিচালিত এক মিনিটের বাজার, জেলা, উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসন কর্তৃক অসহায়দের ঘরে খাদ্য ও ওষুধ পৌঁছানোর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্যোগে হতদরিদ্রদের কাছে খাদ্য পৌঁছানোর কার্যক্রম জনমনে আশা ও উদ্যম বৃদ্ধি করেছে।
উল্লেখ্য, কোনো দুর্যোগ বা মহামারিতে জানমালের ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি দেশ ও সমাজের দুর্বল দিকসমূহ প্রকাশ হয়, যা পরবর্তীতে সংস্কারের উদ্যোগ নিতে সহায়তা করে।
চলমান অভিজ্ঞতার আলোকে সরকারি সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে আগামী জাতীয় বাজেট ও সরকারি দপ্তরসমূহকে ঢেলে সাজাতে হবে। কারণ ক্রমবর্ধমান বাজেটের সম্পূর্ণ টাকা আদায় হয় জনগণের কাছ থেকে; আয়কর, মূল্যসংযোজনী কর, আমদানি কর, নিবন্ধন কর, সড়ক কর, নবায়ন কর, ভ্রমণকর, আবগারি শুল্ক, বিজ্ঞাপন কর ইত্যাদির মাধ্যমে। এসবই জনগণ বিভিন্নভাবে প্রতি বছর পরিশোধ করে থাকে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী ১৯৭২-৭৩ সালে ও ১৯৭৩-৭৪ সালের বাজেট ছিল যথাক্রমে ৭৮৬ ও ৯৯৫ কোটি টাকা এবং জনসংখ্যা ছিল ৭.৫ কোটি। আর ২০১৯-২০ সালের বাজেট ৫,২৩,১৯০ কোটি টাকা এবং জনগোষ্ঠী প্রায় ২০ কোটি। অর্থাৎ ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে মাথাপিছু রাজস্ব ধার্য ছিল ১০৫ ও ১৩৩ টাকা। আর বর্তমানে মাথাপিছু রাজস্ব ধার্য হয়েছে ২৬,১৬০ টাকা মাত্র। বিগত ৪৮ বছরে রাজস্ব বেড়েছে ২৫০ গুণ।
এই সময়ের মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি বা বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক; স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্প, খাদ্যসহ অনেক সেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কিন্তু এই দুর্যোগ বা মহামারিকালীন দুর্গত জনগণের কল্যাণে তাদের অনেকেরই কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়নি। এমনকি অনেক বেসরকারি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা যথাসময়ে পরিশোধ করেনি, যা সুস্পষ্ট মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এসব প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামো অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
যেকোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে উল্লেখযোগ্য কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়ে থাকে। তবে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও বিভাগের কাঙ্ক্ষিত মানের সক্ষমতা, দক্ষতা ও স্বচ্ছতা না থাকায় তা পুরোপুরি কার্যকর হয় না।
আমরা লক্ষ করছি, চলমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারি হাসপাতালগুলোর কাঠামোগত অনেক উন্নতি দরকার; যেমন অক্সিজেন প্ল্যান্ট, সিসিইউ, ভেন্টিলেশন সুবিধা। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স ও দক্ষ টেকনিশিয়ান নিয়োগসহ প্রয়োজনীয় সংখ্যক অ্যাম্বুলেন্স ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ দরকার। বড় ধরনের দুর্ঘটনা বা বিপর্যয় হলে হতাহতদের জরুরি সেবা দিতে আমাদের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালসমূহ প্রস্তুত নয়। সে জন্য জরুরি সেবার মান বৃদ্ধি করতে সব হাসপাতালে জরুরি বিভাগকে আরো বড় করতে হবে। নতুন মেডিকেল কলেজগুলোতে কাঠামোগত সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় লোকবল নিশ্চিত করা ও চিকিৎসাবাণিজ্য রোধ করতে হবে। সর্বোপরি সব সরকারি হাসপাতাল ও কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাসহ মানসম্মত চিকিৎসাকেন্দ্রে পরিণত করার বিষয়ে জোর দিতে হবে, যাতে চিকিৎসার জন্য আর কাউকে বিদেশ যেতে না হয়।
টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ও সূচকসমূহ অর্জনে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনেক। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগসমূহ জাতির যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় যেন গবেষণালব্ধ সহায়তা দিতে পারে, সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগসমূহের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি সব দপ্তরের যোগাযোগ স্থাপন দরকার। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ল্যাবরেটরিতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ কাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি করতে বাজেটে বরাদ্দ দিতে হবে। এর ফলে আশা করি ভবিষ্যতে শিক্ষাঙ্গনে হানাহানি কমবে এবং শিক্ষকরা অনেক বেশি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কাজে মনোনিবেশ করতে পারবেন।
জাতীয় শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক প্রণীত সকল শিক্ষাক্রম পুনঃবিবেচনা করতে হবে, যাতে জাতীয় অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাকে বিবেচনাসহ সার্বজনীন নৈতিকতা, দেশপ্রেম, দৈনন্দিন স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ জীবনযাপনের ধারণা তৈরি ও চর্চায় রূপান্তরিত করতে পারে। এমন শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা পদ্ধতি প্রণয়নসহ শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও শিক্ষকদের মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ দেওয়া জরুরি।
কৃষকের কষ্টার্জিত কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার তৈরি ও বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করতে উচ্চ ফলনশীল যেসব বীজ ও সার কৃষক পুনঃউৎপাদন করতে পারে, এর ব্যবহার বৃদ্ধি করতে কৃষি বিভাগসহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে কাজ করতে হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয়কে খাদ্যের সংরক্ষণাগার বৃদ্ধি এবং খাদ্য বাজারজাতকরণে সরকারি পরিবহনের ব্যবস্থাসহ প্রত্যেকটি রেল পরিবহনের সঙ্গে আলাদা কৃষিবগি থাকতে হবে, যেখানে কৃষিপণ্যসহ কৃষক যাতায়াত করতে পারবে।
শ্রমিকের দক্ষতা, অধিকার ও প্রবাসী শ্রমজীবীদের কল্যাণে শিল্প, শ্রম, কর্মস্থান এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা দরকার, যাতে দেশে শ্রমিক অসন্তোষ না থাকে এবং প্রবাসী শ্রমিকরা অনেক বেশি আয় করতে ও বিদেশে নিরাপত্তা পেতে পারে; যা দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখবে।
স্থানীয় সরকার, সমাজকল্যাণ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় যেকোনো মানবিক বিপর্যয়ে যাতে একসঙ্গে কাজ করতে পারে, তার একটি আইনি কাঠামো তৈরি করতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলী ২০১৯-কে পর্যালোচনা করে আইনে পরিণত করা দরকার।
বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি ও শ্রমিক কল্যাণে বেশি বিনিয়োগের সুযোগ আছে। কারণ উক্ত জনগুরুত্বপূর্ণ চারটি খাতে বাজেটের মাত্র ২৪.৫% ব্যয় হয়। এসব ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ দুর্নীতি কমাতে পারলে সামাজিক নিরাপত্তা, গৃহায়ণ, প্রণোদনাসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় কমে আসবে। সর্বোপরি জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ কাঠামো দরকার।
লেখক : গবেষক