করোনাকালীন শিক্ষা কার্যক্রমে ডিজিটাল দক্ষতা
চলমান করোনা পরিস্থিতিতে সুরক্ষামূলক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে কিছু প্রতিষ্ঠান অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। ইতোমধ্যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইনে পাঠদান, পরীক্ষা গ্রহণ, মূল্যায়ন ও নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে একটি গাইডলাইন বাংলাদেশ মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) গত ৭ মে প্রকাশ করেছে। অনুমান করা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিগগিরই চালু করলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে না। পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। ফলে কীভাবে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা যায়, সেদিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে অনলাইন শিক্ষা বাস্তবায়ন করার জন্য শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল দক্ষতার ব্যবহার ও অংশগ্রহণ প্রত্যাশিত।
ডিজিটাল দক্ষতা বলতে বোঝায় যান্ত্রিক উপায়ে তথ্য ও যোগাযোগের প্রযুক্তিগত উপায়গুলো ব্যবহার করতে পারা। ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন সাধারণ বুদ্ধি ও কারিগরি জ্ঞান। গণমাধ্যমের কল্যাণে বহু মানুষ অনলাইনে খবর পড়েন এবং খবরের ভিডিও দেখেন। অনেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মোবাইলের ক্রেডিট রিচার্জ ও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেন। ফলে বলা যায়, বাংলাদেশের বহু সাধারণ মানুষ ডিজিটাল দক্ষতা অর্জন করেছে। কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল দক্ষতা কতখানি অর্জন করেছে, তা আলোচনাসাপেক্ষ। একাডেমিক ডিজিটাল দক্ষতার কয়েকটি দিক তুলে ধরছি, যেগুলো শিক্ষার্থীদের এই মুহূর্তে জানা খুব প্রয়োজন—
১. শিক্ষার্থীদের জানা দরকার কীভাবে প্রয়োজনীয় ডিজিটাল কনটেন্ট খুঁজতে হয়। যেকোনো বিষয়ে ইন্টারনেটে প্রচুর তথ্য আছে। তবে তথ্যের সত্যতা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ। শিক্ষার্থীদের নির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইট থেকে তথ্য বা কনটেন্ট খুঁজতে হবে। যেমন—একাডেমিক জার্নাল থেকে কোনো বিষয়ের ওপর নির্ভরযোগ্য প্রবন্ধ খুঁজতে হলে শিক্ষার্থীদের উচিত হবে গুগল স্কলার সাইটে যাওয়া। একইভাবে গুগল বুকস ও আমাজন সাইটগুলো থেকে বিশ্বের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত বইগুলোর কিছু পাতা ফ্রিতে দেখা যাবে। তা ছাড়া বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছু বিখ্যাত জার্নালের পিডিএফ ভার্সনে প্রবেশাধিকার আছে। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত আইডি ব্যবহার করে অনলাইনে নির্দিষ্ট বইয়ের সফট কপিও পড়তে পারে।
২. শিক্ষার্থীদের জানা দরকার কীভাবে ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করতে হয়। ইন্টারনেটের কল্যাণে শিক্ষার্থীরা এখন বহু সাইট থেকে ডিজিটাল রিসোর্স সম্পর্কে জানতে পারে। যেমন—বহু দেশের বহু শিক্ষক কোনো বিষয়ের ওপর তাঁদের লেকচারের ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করেন। শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ের ওপর বিজ্ঞানী, গবেষক ও অধ্যাপকদের সাক্ষাৎকার রয়েছে, যা দেখে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হতে পারে। শুধু ডিজিটাল রিসোর্স উপভোগ করাটাকে আমি বলব ‘অক্রিয় ডিজিটাল দক্ষতা’। তাই তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহারের জন্য চাই ‘সক্রিয় ডিজিটাল দক্ষতা’। অর্থাৎ, একজন শিক্ষার্থীকে ডিজিটাল তথ্য উপভোগ করার পাশাপাশি তা তৈরি করার দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন—কোনো শিক্ষকের লেকচারের ভিডিও দেখে বা অডিও শুনে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হয়। এর উপকারিতা আরো বাড়তে পারে যদি শিক্ষার্থীরা অডিও বা ভিডিও উপভোগ করার পর নিজেই অডিও বা ভিডিও ফাইল তৈরি করে। সেগুলো সহপাঠীদের শেয়ার করতে পারলে তাদের ডিজিটাল দক্ষতা আরো একধাপ এগিয়ে যায়।
৩. শিক্ষার্থীদের জানা দরকার কীভাবে নিজের ডিজিটাল কনটেন্টের মালিকানা সৃষ্টি করা যায় এবং কেন তা গুরুত্বপূর্ণ। করোনা পরিস্থিতিতে শ্রেণিকক্ষে বসিয়ে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই ধারণা করা যায়, শিক্ষার্থীরা অনলাইন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। যেমন—কুইজ পরীক্ষায় অংশ নেবে ও নির্ধারিত বিষয়ের ওপর অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করবে। যেহেতু ডিজিটাল লেখা খুব সহজে কপি ও অন্যকে শেয়ার করা যায়, সেহেতু শঙ্কা থাকে, কেউ অন্যের ডিজিটাল কনটেন্টকে নিজের বলে ব্যবহার করতে পারে। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় প্ল্যাগারিজম। সরল বাংলায় এটিকে বলা হয় নকল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে, প্ল্যাগারিজম একটি শাস্তিমূলক অপরাধ। সুতরাং শিক্ষার্থীদের সতর্ক থাকতে হবে নিজের ডিজিটাল কনটেন্টের প্রতি মালিকানা সৃষ্টি করতে, যাতে কেউ কপি করতে না পারে। নিজের ডিজিটাল কনটেন্টের প্রতি মালিকানা সৃষ্টি করার একটি সহজতম উপায় হচ্ছে নিজের তৈরি ফাইল বা কনটেন্টের জন্য পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা; যেমনটি আমরা নিজের মোবাইলের ও ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করি।
উপরোক্ত তিনটি বিষয়ের (নির্ভরযোগ্য ডিজিটাল কনটেন্ট খুঁজতে পারা, কনটেন্ট তৈরি করতে পারা ও কনটেন্টের ওপর নিজের মালিকানা সৃষ্টি করতে পারা) ওপর শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জন করা এবং তা ব্যবহার করতে পারাটা চলমান করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে সহায়ক হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়