ওয়ার্কিং ফ্রম হোম : তথ্যপ্রযুক্তি ও নতুন সম্ভাবনা
কোভিড-১৯ পরিস্থিতির আগে আমি ও আমার একাধিক সহকর্মী একটি প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। প্রজেক্টটির মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত কিছু শিক্ষার্থীকে উন্নয়ন ও সহিষ্ণুতা সম্পর্কে ১৪ সপ্তাহব্যাপী প্রশিক্ষণ দেওয়া। ইউএসএইডের অর্থায়নে ও নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে প্রজেক্টটি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশের খুলনাভিত্তিক রূপান্তর নামে একটি বেসকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান। প্রশিক্ষণের জন্য কিছু শ্রেণি-কার্যক্রম ছিল। যেমন—শিক্ষকের লেকচার দেওয়া ও শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যার ওপর তাদের নিজস্ব মতামত প্রকাশের জন্য অনুপ্রাণিত করা। প্রশিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষণার্থীরা নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট পাবে। সার্টিফিকেট প্রাপ্তির পূর্বশর্ত হলো নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত অনলাইন জরিপে প্রশিক্ষণার্থীদের অংশ নিতে হবে এবং কিছু সংক্ষিপ্ত অ্যাসাইনমেন্ট অনলাইনে সম্পন্ন করতে হবে। নিঃসন্দেহে, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট পাওয়ার ব্যাপারটি খুবই আনন্দের। কিন্তু প্রজেক্টটির পাঁচটি ক্লাস হওয়ার পর করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মতোই আমার কর্মস্থল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হলো।
এমতাবস্থায় নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জানতে চাওয়া হলো, শিক্ষার্থীদের যদি ইন্টারন্টে ব্যবহারের প্রয়োজনীয় খরচ দেওয়া হয় তাহলে তারা বাকি ক্লাসগুলো সম্পন্ন করতে ইচ্ছুক কি না। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেল। আমাদের, অর্থাৎ শিক্ষকদের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হলো, জুম অ্যাপ ব্যবহার করে বাকি ক্লাসগুলো অনলাইনে সম্পন্ন করতে পারব কি না। আমরাও ইতিবাচক সাড়া দিলাম। এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা জুম ও গুগল ক্লাস নামক দুটি অ্যাপ ব্যবহারের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। দুই সপ্তাহের মধ্যে বাড়িতে অবস্থান করে বাকি ক্লাসগুলো জুমের মাধ্যমে সম্পন্ন করেছি এবং খুব দ্রুত শিক্ষার্থীরা নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের সার্টিফিকেটগুলো পেয়ে যাবে। এখানে দেখা যাচ্ছে, ভিন্ন ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে থেকেও অনলাইনের মাধ্যমে আমরা যোগাযোগ রক্ষা করতে পেরেছি এবং উভয় পক্ষই সম্মিলিত পেশাগত কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছি।
বলা বাহুল্য, অন্য পেশার কর্মীরাও এই করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইনে বাড়িতে অবস্থান করে, অর্থাৎ ‘ওয়ার্কিং ফ্রম হোম’ পদ্ধতিতে তাদের পেশাগত কাজ করছে। যেহেতু করোনা পরিস্থিতিতে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হচ্ছে, তাই মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পেশাগত যোগাযোগ করছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্যবসায়-সংক্রান্ত মাগাজিন ফোর্বস ২৩ মে ২০২০ তারিখে প্রকাশ করেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গ বিশ্বের ধনীর তালিকায় সপ্তম থেকে চতুর্থ স্থানে উন্নীত হয়েছেন। এর বড় কারণ হলো, গত দুই মাসের করোনাকালে ফেসবুকের মাধ্যমে ই-শপিং জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বাংলাদেশেও দেখা যায়, বহু লোক অনলাইনে তাঁদের ব্যবসা পরিচালনা করেন। ফেসবুকে লাইভে এসে তাঁদের পণ্যের বিজ্ঞাপন দেন। এ ছাড়া বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক বিজনেস পেজ রয়েছে। বাংলাদেশে ঈদ উপলক্ষে অনলাইন শপিংয়ের জনপ্রিয়তা দেখা গেছে। ধারণা করা যায়, এটি আরো বাড়বে। তথ্যপ্রযুক্তির অন্যান্য মাধ্যমও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যেমন—বহু মানুষ ইউটিউবে খবর দেখছে, এফএম রেডিওতে খবর শুনছে এবং অনলাইনে খবর পড়ছে।
ওয়ার্কিং ফ্রম হোম পদ্ধতিটি কার্যকর এই কারণে, মানুষ এখন শান্তভাবে বসে, সময় নিয়ে ও অধিক মনোযোগের সঙ্গে কাজ করতে পারছে। কাজের রেকর্ড অনলাইনে জমা হচ্ছে। ফলে পরে যেকোনো মাসের বা বছরের সব কাজের ডকুমেন্টেশন করা যাবে অনায়াসে। এই পদ্ধতিটি ব্যয়বহুলও হবে না, যদি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ভৌতিক কাঠামোর আয়তন কমিয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ, অফিস স্পেস, পরিবহন, গাড়ি পার্কিং ও ইত্যাদি খাতে ব্যয় কমিয়ে আনতে পারবে। এসব খাতে বরাদ্দ অর্থ কর্মীদের তথ্যপ্রযুক্তির লজিস্টিক সাপোর্ট প্রদানে ব্যয় করা যেতে পারে।
ঢাকা শহরের প্রেক্ষিতে ওয়ার্কিং ফ্রম হোম সবচেয়ে কার্যকর ও প্রত্যাশিত পদ্ধতি। কারণ, যানজটের কারণে বহু মানুষকে এক থেকে তিন ঘণ্টা আরো বেশি সময় রাস্তায় কাটাতে হয়। যানজটে বসে গাড়িগুলো অযথাই কার্বন পোড়ায়। ওয়ার্কিং ফ্রম হোম পদ্ধতিতে কাজ করার সংস্কৃতি দেশব্যাপী চালু হলে মানুষ কাজের জন্য আগের চেয়ে বেশি সময় পাবে এবং দেশবাসী পাবে যানজটমুক্ত, ধুলা ও ধোঁয়াবিহীন পরিবেশ। বড় ব্যাপার হলো, ওয়ার্কিং ফ্রম হোম পদ্ধতিতে সুস্বাস্থ্য রক্ষা করা যাচ্ছে। ভাইরাসের বিস্তৃতি কমানো সম্ভব হচ্ছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়