এসএসসির ফল প্রকাশ ও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম
এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসাজনক যে চলমান করোনা পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশের শিক্ষা বোর্ডগুলো ২০২০ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে পেরেছে। ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এ বছর মোট ২০ লাখ ৪৭ হাজার ৭৭৯ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল। পুরো দেশে পাসের হার ৮২ দশমিক ৮৭ । এ বছর জিপিএ ৫ পেয়েছে এক লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ শিক্ষার্থী, যা গত বছরের তুলনায় বেশি।গত বছর এক লাখ পাঁচ হাজার ৫৯৪ শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ অর্জন করেছিল। এ বছর সব শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে রাজশাহী বোর্ডে পাসের হার বেশি, ৯০ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
শিক্ষার্থীদের এই সাফল্যের পেছনে জড়িয়ে আছে বহু শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের অক্লান্ত পরিশ্রম। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বর্তমান করোনা পরিস্থিতি এই পরিশ্রমের সাফল্যকে উদযাপন করতে দিল না। শিক্ষার্থীরা আগের মতো দলে দলে গিয়ে শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাতে পারবে না। শিক্ষার্থীরাও তাদের প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে পারবে না। আত্মীয়স্বজন সশরীরে ফুল, মিষ্টি বা উপহার নিয়ে অভিনন্দন জানাতে যেতে পারবে না।
এ ছাড়া করোনা-দুর্যোগ শিক্ষার্থীদের উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে প্রবেশের আনন্দে বাধা দিয়েছে। কলেজে ভর্তি হওয়া ও শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। কারণ, সহসাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, যেহেতু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি ও মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, সেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন চালু করলে ভাইরাসটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো না খুলে আপাতত অনলাইনে কীভাবে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি ও শ্রেণি কার্যক্রম চালু করা যায়, সেদিকে অধিক মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের কলেজগুলোতে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত লজিস্টিক সহায়তা নেই। শিক্ষার্থীদেরও কম্পিউটার, স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও কারিগরি জ্ঞান নেই। অন্যদিকে করোনা পরিস্থিতির অবসানও খুব দ্রুত দেখতে পাব, সে সম্ভাবনাও নেই। তাহলে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ভর্তি ও শিক্ষা কার্যক্রম কি একেবারেই বন্ধ থাকবে? সম্পূর্ণভাবে শিক্ষা কার্যক্রমকে বন্ধ রাখা ভবিষ্যতে কেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে ভাবতে হবে।
শিক্ষা-সংক্রান্ত ভার্চুয়াল সুবিধা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন থেকে প্রস্তুত করা যেতে পারে, যাতে অন্তত শিক্ষকরা তাঁদের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের তথ্যপ্রযুক্তিগত অবকাঠামো ব্যবহার করে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেকচার প্রস্তুত করে তা অনলাইনে আপলোড করতে পারেন। অনলাইন বা ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় নানাবিধ সীমাবদ্ধতা বা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেগুলো স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হবে। অনলাইন পদ্ধতিতে নানাবিধ সুবিধাও রয়েছে। যেমন, একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের অডিও বা ভিডিও লেকচার শুধু তাঁর শিক্ষার্থীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং সারা দেশের শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে তা উপভোগ করতে পারবে এবং উপকৃত হবে।
করোনা দেশব্যাপী সংকট সৃষ্টি করেছে। এটি যেমন সত্য, তেমনি কিছু নতুন সম্ভাবনাও সৃষ্টি করেছে। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সম্ভাবনা হলো বিখ্যাত কলেজগুলোর শিক্ষকদের পাঠদান শুধু নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। এতে করে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য কিছুটা হলেও কমবে। দেশের সেরা কলেজগুলোর অন্যতম নটর ডেম কলেজ, ঢাকা কলেজ, ভিকারুননিস নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, হলিক্রস কলেজ এবং রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ। উক্ত কলেজের শিক্ষকরা যদি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর তাঁদের লেকচারের অডিও ও ভিডিও ফাইল ইন্টারনেটে আপলোড করেন, তাহলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরাও অনলাইনের মাধ্যমে উপভোগ করতে পারবে। ধারণা করা যায়, করোনা পরিস্থিতি আমাদের আরো বহুদিন ভোগাবে। তাই অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার করার জন্য কী কী বাস্তবসম্মত পদ্ধতি বিবেচনায় আনা যেতে পারে, তা নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ চিন্তা করতে পারে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়