করোনা ও অভিবাসন : পরবর্তী বিশ্ব এবং বাংলাদেশ
বিশ্ব এখন দ্বিধাগ্রস্ত। করোনা-পরবর্তী পৃথিবী কখন আসবে তার যেমন অনিশ্চয়তা রয়েছে, তেমনি দ্বিধা রয়েছে করোনা-পরবর্তী পৃথিবীটা কেমন হবে তা নিয়ে। তবে এই ‘পরবর্তী’ শব্দটা নিয়েও রয়েছে সংশয়, কারণ ‘পরবর্তী’ সময় মানে হয়তো করোনা শেষ হয়ে যাওয়া নয়, বরং সংক্রমণের হার কমে আসা একটা সময়ের কথা। আমরা এ মুহূর্তে আশা করতে পারি, যাকে বলা হচ্ছে ‘নিউ নরম্যাল’।
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বল্পমাত্রার সংক্রমণ চলবে আগামী কয়েক বছর ধরে। ভ্যাকসিন ও ওষুধের দিকে চেয়ে থাকার সময় যদি শেষ হয় তবুও। তার মানে পাল্টে যাবে পৃথিবী।
পরিবর্তিত সেই পৃথিবীতে অভিবাসন চিত্রটি কেমন হবে, যেখানে পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অভিবাসন এখন একটি অন্যতম নিয়ামক? আইএলওর সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর ৩ দশমিক ৩ শতাংশ অভিবাসী, যাদের মধ্যে বাংলাদেশ একটি অন্যতম অভিবাসী প্রেরণকারী দেশ। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে আট থেকে ১০ লাখ কর্মী বৈধপথে অভিবাসন করে থাকে। তাহলে বাংলাদেশের অভিবাসন খাতটিই বা কেমন রূপ ধারণ করবে?
অভিবাসনের কয়েকটি দিক এক্ষেত্রে বিবেচনা করা যেতে পারে। যেমন : অভিবাসীর সংখ্যা, অভিবাসনের ধরন, অভিবাসন ব্যয়, অভিবাসন থেকে আয় এবং সর্বোপরি অভিবাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকিগুলো। কোনো সন্দেহ নেই, করোনা-পরবর্তী সময়ে পৃথিবীজুড়ে একটি মন্দা তৈরি হবে, মানুষ চাকরি হারাতে থাকবে (আইএলও বলছে প্রায় ২৫ মিলিয়ন) এবং এর ফলে অভিবাসীদেরও একটি বড় অংশ চাকরি বা কাজ হারাবে এবং দেশে ফিরে আসবে। এই মুহূর্তে বিভিন্ন সোর্স বলছে এটা কয়েক লাখ হতে পারে। মন্দা দেখা যাবে কর্মী গ্রহণকারী এবং প্রেরণকারী উভয় দেশেই। ফলে একদিকে যেমন বিশ্বজুড়ে অভিবাসী কর্মীদের চাহিদা কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি ঝুঁকি রয়েছে কর্মী প্রেরণকারী দেশগুলো থেকে বিভিন্ন অনিয়মিত উপায়ে অভিবাসন বেড়ে যাওয়ার। পরিণতিতে পুরোনো কর্মী ছাঁটাইয়ের পাশাপাশি নতুন করে অভিবাসনের অনিশ্চিত রূপ সার্বিকভাবে একটি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। তবে সন্দেহে নেই যে নিয়মিত অভিবাসীর সংখ্যা অনেকটা কমে আসার পাশাপাশি অনিয়মিত অভিবাসীর সংখ্যা বাড়তে পারে। একইসঙ্গে মানবপাচার ও মানব স্মাগলিং সমস্যাও বাড়তে পারে।
গবেষণা বলে, বাংলাদেশের অভিবাসন ব্যয় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয় নীতি এক্ষেত্রে কাজ করে না, যার অন্যতম প্রধান কারণ মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের ওপর অভিবাসীদের নির্ভরশীলতা এবং বড় একটি অংশের দেশীয় নিয়োগকারী এজেন্সিগুলোর ‘যা খুশি তাই’ অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ প্রক্রিয়া, যার অধিকাংশই কাগজে-কলমে দেখা যায় না। আগামী দিনে যদি এই অভিবাসন ব্যয় অনেক বেড়ে যায় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এর অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমত কর্মী চাহিদা কমে যাবে বিভিন্ন দেশে, আর করোনা সংকটকালে নিয়োগকারী এজেন্সিগুলোর অনেক ব্যবসায়িক ক্ষতি হচ্ছে, যা তারা পুষিয়ে নিতে চাইবে।
অথচ এই মুহূর্তে কত হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী কর্মীর কত কোটি অগ্রিম টাকা মধ্যস্বত্ত্বভোগী আর এজেন্সিগুলোর হাতে জমা পড়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই! আবার এজেন্সিগুলোও ব্যবসায়িকভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সে যা-ই হোক, করোনার প্রকোপ কমার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববাজারে কর্মীর চাহিদা কমে আসলে অনেক বেশি টাকা দিয়েও বাংলাদেশের কর্মীরা অভিবাসনের জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না, কারণ বাংলাদেশের মানুষ ১০-২০ লাখ টাকাও খরচ করে থাকে ইউরোপে যাওয়ার জন্য।
সঙ্গত কারণেই কমে আসবে রেমিটেন্স প্রবাহ। ইতোমধ্যে প্রবাসে অবস্থানরত অভিবাসী কর্মীরা কী কী কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, সে ব্যাপারে এখনই খুব সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যাংকের তথ্য বলছে, রেমিটেন্স প্রবাহ অনেক কমে গেছে। এর হয়তো অনেক কারণ রয়েছে। যার মধ্যে বেতন-ভাতা না পাওয়া, আংশিক বেতন পাওয়া ছাড়া লকডাউনও একটি কারণ; যেখানে রেমিটেন্স প্রেরণকারী অনেক প্রতিষ্ঠানই বন্ধ। কিন্তু আগামী দিনে কর্মীরা সঠিকভাবে তাদের পাওনা বেতন-ভাতা সবাই পাবে কি না, সেটা নিয়ে অনেকটাই সন্দেহ রয়েছে। পক্ষান্তরে অভিবাসীর সংখ্যাই যদি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কমে যায় তবে সার্বিকভাবে নিম্নগামী হবে রেমিটেন্স প্রবাহ। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হবে না।
আরেকটি বিষয় দেশের ভেতর সংকট হয়ে দাঁড়াবে। যদি কোনোভাবে দেশে ফিরে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়, তাহলে তাদের পুনঃএকত্রীকরণ বা রি-ইন্টিগ্রেশন সমস্যা বাড়বে। ফিরে আসা অভিবাসীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মনোঃসামাজিক রি-ইন্টিগ্রেশনের উদ্যোগ এখনই অত্যন্ত সীমিত, সেখানে যদি বিপুল অভিবাসী কর্মী ফেরত আসে তবে তাদের দায়িত্ব নেওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
সার্বিকভাবে এখনই উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা করতে হবে। আমাদের জন্য ভালো দিক হলো শুধু অভিবাসী কর্মীদের জন্য একটি পৃথক মন্ত্রণালয় আছে, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি আছে প্রায় ১৪০০ নিয়োগকারী এজেন্সি, বায়রা, সরকারি ও বেসরকারি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, বেশ কিছু এনজিও, অভিবাসনবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং অভিবাসন বিশেষজ্ঞ। সর্বোপরি আছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যদি সবাই মিলে চেষ্টা করা হয়, তাহলে হয়তো সমস্যা অনেকটাই কমিয়ে আনা যাবে।
প্রতিরোধের ব্যবস্থাটি করতে হবে প্রথমেই, যেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করবে। এই মন্ত্রণালয়ে কর্মীদের প্রতি মানবিক হওয়ার আহ্বান রইল। বাংলাদেশের কর্মীদের যাতে ব্যাপকহারে ছাঁটাই না করা হয়, সে উদ্যোগটি বিদেশে ও দেশের ভেতর আরো জোরদার করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা, যেটা সরকার কিছু কিছু করছে বলে দাবি করছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে মনে রাখতে হবে, কর্মী ছাঁটাই ইত্যাদি যা-ই ঘটুক না কেন, দক্ষ ও স্বল্প দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা সব সময় থাকবে। সুতরাং সরকারকে একদিকে যেমন দক্ষতা বৃদ্ধি কার্যক্রম আরো বাড়াতে হবে, অন্যদিকে ফিরে আসা কর্মীদের মধ্যে থেকে দক্ষ কর্মী যাচাই-বাছাই করে তাদের ব্যাপারে কর্মী গ্রহণকারী দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে; ফলে কর্মী সরবরাহ বাড়ানো বা কিছুটা স্থিতিশীল রাখা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারে নতুন প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আরপিএল (রিকগনিশন অব প্রিঅর লার্নিং) পদ্ধতির আরো প্রসার ঘটানো। দক্ষ হয়ে বিদেশে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে বিভিন্ন প্রচারণা কার্যক্রম এনজিওদের সাহায্যে আরো বাড়াতে হবে। সাথে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর দক্ষতার মান আসলেই বাড়ানোর যথাযথ কারিকুলাম উন্নয়ন ও মানসম্পন্ন প্রশিক্ষকদের ব্যবহার করতে হবে; পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সনদসম্পন্ন সার্টিফিকেট নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে অংশীদারত্ব বাড়াতে হবে। নতুন দেশ খুঁজে বের করতে হবে, যেখানে মানসম্মত অভিবাসনের সুযোগ অনেক বেশি (জাপান, মরিসাস, কোরিয়ার মতো)। আবার লক্ষ রাখতে হবে, কিছু কিছু দেশ তাদের অর্থনীতিকে সচল রাখতে নতুন করে অভিবাসী কর্মী গ্রহণও করবে। মোদ্দা কথা হলো, সরকার ও নিয়োগকারী সংস্থা বা বায়রা, সবাইকে অনেক বেশি অভিনব পন্থায় কাজ করতে হবে, আগের মতো একই ধারায় কাজ করলে আর হবে না।
আরেকটি বড় কাজ যেটা দীর্ঘ সময় ধরে হচ্ছে না, তা হলো, নিয়োগকারী এজেন্সিগুলোর ওপর প্রকৃত পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে, প্রয়োজনে হয় এসব এজেন্সির শ্রেণিবিন্যাস করতে হবে, নয় তাদের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। কেননা এত এজেন্সির অধিকাংশই সরাসরি কাজ করে না এবং তাদের মনিটরিং করাটাও কঠিন।
সর্বোপরি, মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের যেকোনোভাবে দায়বদ্ধতার মধ্যে আনতে হবে, যাতে অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনা যায়। এ ছাড়া পাচার ও স্মাগলিং প্রতিরোধে আরো বেশি সচেতন হতে হবে, জনসচেতনতা বাড়াতে হবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে নজরদারি বাড়াতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, অভিবাসন খাতের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল আমাদের অর্থনীতি। সুতরাং ‘করোনা যাক, তারপর দেখা যাবে’ এটা না ভেবে এখন থেকেই আমাদের পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
লেখক : অভিবাসন গবেষক ও উন্নয়নকর্মী। বর্তমানে তিনি ডেভকম নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ইতোপূর্বে তিনি ব্র্যাকের কর্মসূচি প্রধান এবং আইওএম ও আইএলওর পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন।