জিন্সের জায়গা দখল করছে লেগিংস!
যত দোষ নন্দঘোষ। তবে এ ক্ষেত্রে যে নন্দঘোষের কোনো দোষ নেই তা তিনি নিজেই বলতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে দোষটা হচ্ছে লেগিংস ও ইয়োগা প্যান্টের। বলছি জিন্স প্যান্টের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এক সময় ৩০০ মার্কিন ডলারে বিক্রি হওয়া জিন্স প্যান্ট এখন মার খেয়ে যাচ্ছে ১০০ মার্কিন ডলারের লেগিংস ও ইয়োগা প্যান্টের কাছে। বিক্রেতাদের দাবি, জিন্স প্যান্টের কাটতি কমে যাওয়ার পেছনে লেগিংস ও ইয়োগা প্যান্টই দায়ী। চলুন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্টের সৌজন্যে জেনে আসি তাদের এই দাবি কতটা যৌক্তিক।
মার্কিনিদের আগের মতোই জোড়ায় জোড়ায় জিন্স প্যান্ট কেনা হয়। তবে এখন সে জোড়ার পরিমাণ এখন অনেকটাই কমে গেছে। পাশাপাশি আগের মতো তারা জিন্স প্যান্টের পেছনে অত ডলারও খরচ করতে চান না।
কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের জিন্স প্যান্টের প্রতিষ্ঠান ট্রু রিলিজয়নের বিক্রি কমতে শুরু করেছিল। এই সপ্তাহে এসে তা এতটাই কমে গেছে যে প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া হয়ে এর ২৭ টি দোকান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। অথচ এক দশক আগে জিন্স প্যান্টের এই ব্র্যান্ডটির চাহিদা ছিল তুঙ্গে। যখন একজোড়া জিন্স প্যান্ট তারা ১০০ ডলারে বিক্রি করত। এসব জিন্স প্যান্টের পেছনের দুটি পকেটে প্রতিষ্ঠানের সাক্ষরসূচক চিহ্ন, অর্থাৎ ঘোড়ার খুরের নাল সুতার দ্বারা সেলাই করা থাকত। এতে ২০০৭, ২০১২ ও ২০১৩ তে তাদের ব্যবসা ফুলেফেঁপে তিনগুণ হয়ে যায়। এ ছাড়া ট্রু রিলিজিয়নের ৪৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বার্ষিক রাজস্ব দেওয়ারও রেকর্ড রয়েছে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউরোমনিটর ইন্টারন্যাশনালের সূত্র অনুযায়ী, সেভেন ফর অল ম্যানকাইন্ড, ট্রু রিলিজিয়ন, জো’এস জিন্স এবং হাডসনের মতো জিন্স প্যান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সুপার প্রিমিয়াম জিন্স প্যান্টের বিক্রি কমে গেছে আট শতাংশ। দুই বছরের মন্দার পর সামগ্রিকভাবে ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে জিন্স প্যান্টের বাজার কিছুটা চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ লেভিস, এইচ অ্যান্ড এম এবং ফরএভার ২১-এর মতো কম দামি জিন্স প্যান্ট ব্র্যান্ডের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
এ ব্যপারে ট্রু রিলিজিয়নের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা দালিভর সিনডার বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের দেলাওয়ারে অবস্থিত ব্যাংরাপ্টসি কোর্টে একটি নথি ফাইলে লিখেন, ‘কত কয়েক বছরে ডেনিমের বাজারের বেশ অবনতি হয়েছে। পাশাপাশি লেগিংস ও ইয়োগা প্যান্টের মতো ফাস্ট ফ্যাশনের কাটতি বেড়ে যাওয়ায় প্রতিযোগিতা বেড়ে গিয়েছে। এতে খুচরা বিক্রেতাদের কম দামে জিন্স প্যান্ট বিক্রি করতে হচ্ছে।’
এ ছাড়া মার্কিনিদের বেশিহারে তাদের প্যান্টের চাহিদা ইয়োগা প্যান্ট এবং লেগিংস দিয়ে পূর্ণ করছেন। এটা পড়ে তারা যে শুধু ব্যায়ামাগারে যাচ্ছেন তা কিন্তু না, লেগিংস ও ইয়োগা প্যান্ট পড়ে তারা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতেও যাচ্ছেন। লেগিংসের মতো দেখতে ট্রু রিলিজিয়নের ৩১৯ মার্কিন ডলারের সরু জিন্স প্যান্টের জায়গা দখল করেছে লুলুলেমনের ৯৮ মার্কিন ডলারের ইয়োগা প্যান্ট।
কলম্বিয়া বিজনেস স্কুলের রিটেইল স্টাডিজের পরিচালক মার্ক কোহেন বলেন, ‘আপনাকে চারপাশ দেখতে হবে। আজ থেকে দশ বছর আগে নকশাকারকদের নকশা করা দামি জিন্স পড়া চল ছিল। তবে এখন আর সে চল নেই। বর্তমান ফ্যাশন সচেতন মেয়েরা ইয়োগা প্যান্ট পড়ছে’।
২০০২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ম্যানহ্যাটনের বিচে প্রতিষ্ঠিত হয় ট্রু রিলিজিয়ন। তারা ভালো মানের জিন্স প্যান্ট সরবরাহ করতে শুরু করে। ট্রু রিলিজিয়নের জিন্স প্যান্টগুলোর যেমন নকশায় ভিন্নতা ছিল, তেমনি এগুলো বাড়িতেই ধোয়া যেত।
ক্যানাকর্ড জেনুইটির বাজার বিশেষজ্ঞ ক্যামিলো লিয়ন বলেন, তখনকার সময়ে ১০০ মার্কিন ডলারে একজোড়া জিন্সের প্যান্ট গলাকাটা দাম নিচ্ছে বলে মনে হতো। তবে কিছু কিছু ব্যক্তি ১৫০, ২০০, ৩৫০ মার্কিন ডলারেও জিন্স প্যান্ট কিনত। এতে দাম দ্রুত বেড়ে যায় এবং ভোক্তারা বাধ্য হয় বেশি দামে জিন্স প্যান্ট কিনতে।
ট্রু রিলিজিয়নের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠতে শুরু করে। এ জন্য ব্রিটনি স্পিয়ার্স, ক্যানি ওয়েস্টের মতো তারকারা একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন । কারণ, তারা এই ট্রু রিলিজিয়ন ব্র্যান্ডের জিন্স পড়েই ছবি তোলার জন্য আলোকচিত্রশিল্পীদের সামনে দাঁড়াতেন।
তবে ২০১২ সালে তাদের এই মধুর ব্যবসা তিক্ত হতে শুরু করে। প্রতিযোগিতা বেড়ে যায় এবং চাহিদা কমে যায়। ট্রু রিলিজিয়ন তাদের পণ্যে ছাড় দেওয়া শুরু করে এবং টাওয়ার ব্রুক ক্যাপিটাল পার্টনারস নামের একটি ব্যক্তিগত ইকুইটি ফার্মকে ক্রেতা হিসেবে খুঁজে পায়। তারা প্রায় ৮৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য ক্রয় করে ট্রু রিলিজিয়ন থেকে। এরপরও ট্রু রিলিজিয়নের জিন্স প্যান্টের মূল্য কম হতে শুরু করে। গত বছর ট্রু রিলিজিয়নের দেওয়া রাজস্বের পরিমাণ মাত্র ৩৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৩ সাল থেকে যা ২৫ শতাংশ কম এবং ২০১৬ সালে এদের ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ইউরোমনিটরের সূত্র মতে, যুক্তরাষ্ট্রের দোকানদাররা বিশাল লোগোসহ কম দামি অথবা তুলনামূলক কমদামি জিন্সগুলো দোকানে রাখে। এসব লোগো চাইলে পরিবর্তনও করা যায়। তাই দামি এবং কমদামি জিন্সের মধ্যে পার্থক্য করাটা কঠিন হয়ে পড়ে।
ইউরোমনিটরের সূত্র মতে, ৪৫ এবং ৯০ মার্কিন ডলারের জিন্স প্যান্ট বাজারে ছেড়ে পুরুষ ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় এখন বেশ ওপরই রয়েছে ডেনিম। তবে নারীরা ডেনিমের পরিবর্তে এইচ অ্যান্ড এম, ওল্ড নেভি এবং ফরেভার ২১-এর মতো ইকোনমি ব্র্যান্ডের দিকেই ঝুঁকে রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তিগত ব্র্যান্ড যেমন ওয়ালমার্ট অ্যান্ড টারগেটও রয়েছে নারীদের পছন্দের তালিকায়। (ইউরোমনিটর জানাচ্ছে, গতবছর নারীদের ইকোনমি ব্র্যান্ডগুলো বিক্রি হয়েছে ৩৯ শতাংশ। অন্যদিকে সুপার প্রিমিয়াম জিন্সের বিক্রি ছিল ৯ শতাংশ)
মায়ামির রিটেইল সিস্টেম রিসার্চের ব্যবস্থাপনা অংশীদার পাওলা রোসেনব্লাম বলেন, ‘আমি রকেট বিজ্ঞানে বিশ্বাস করি না। বিশাল এই জিন্সের বাজার আস্তে আস্তে ছোট হচ্ছে এবং সেটা ক্রমাগতভাবে কমতে থাকবে। কেন আপনি ৩০০ মার্কিন ডলারের ফাটা-ছেঁড়া জিন্স কিনবেন যখন ৬০ মার্কিন ডলারে আপনি একই জিনিস পাচ্ছেন?’