দাঁত ব্যথায় করণীয়
দাঁত ব্যথার সমস্যা খুব সচরাচর হলেও এর যে কী ভীষণ কষ্ট, তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। সাধারণ চিকিৎসার পাশাপাশি এর অনেক উন্নত চিকিৎসাও বাংলাদেশে রয়েছে। আজ ২৮ মার্চ এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ১৯৮৮তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন দন্ত্যরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এ টি এম নজরুল ইসলাম।
প্রশ্ন : দাঁতের ব্যথা অত্যন্ত কষ্টের একটি বিষয়। যার হয় সেই কেবল বোঝে এই ব্যথা কতটা তীব্র। দাঁতের ব্যথার প্রধান কারণ কী?
উত্তর : আমাদের কাছে অধিকাংশ রোগী দাঁত ব্যথার সমস্যা নিয়ে আসে। এই ব্যথা সাধারণত দাঁতের সমস্যার কারণেই হয়। অথবা কিছু সাপোর্টিভ স্ট্রাকচার (সাহায্যকারী গঠন) যেমন, দাঁতের সংশ্লিষ্ট মাড়ি, হাড় এসবের সমস্যার কারণেও দাঁতে ব্যথা হয়। তবে প্রধানত দাঁতের প্রদাহের কারণে দাঁতে ব্যথা হয়।
একজন রোগী আমাদের কাছে এলে আমরা তাদের রোগটা বোঝার চেষ্টা করি। রোগীর ইতিহাস জেনে নিই। জানতে চাই অন্য কোনো সমস্যা আছে কি না। মুখের ভেতর আলো (লাইট) দিয়ে চেকআপ করে দেখি দাঁতে কোনো গর্ত বা এ জাতীয় কিছু আছে কি না।
প্রশ্ন : কী কারণে দাঁতের ব্যথা হচ্ছে সেটি বোঝার কি কোনো উপায় রয়েছে?
উত্তর : ডেন্টাল ক্যারিজ, যাকে অনেক সময় বলা হয় দাঁতে পোকা বা দাঁতে ক্ষয়-এটি অন্যতম প্রধান কারণ। দাঁতের লেয়ারগুলোতে প্রথমে এনামেল থাকে, এরপর থাকে ডেনটিন। ডেনটিন অংশটা স্পর্শকাতর। তার মধ্যে স্নায়ু বা নার্ভের যোগ থাকে। নার্ভ রিসেপটর থাকে যেগুলো মানুষের ব্যথা বা অনুভূতিকে গ্রহণ করতে পারে। তার নিচে দাঁতের একটি মজ্জা বা চেম্বার থাকে সেখানে স্নায়ুতন্ত্র, রক্ত নালি থাকে। যখনই এনামেল বা ওপরের অংশ ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যায় এবং ভেতরে যে ডেনটিনের অংশ রয়েছে, ওই পর্যন্ত ক্ষয় চলে আসে তখন রোগীদের রিভার্সেবল ব্যথা হয়। হঠাৎ করে কোনো কিছু ঠান্ডা, গরম, মিষ্টি, টকজাতীয় খাবারে শিরশির করে। যেহেতু এনামেল ক্ষয় হয়ে ডেনটিন বের হয়ে যাচ্ছে, ওই জায়গাটি উচ্চ স্পর্শকাতর (হাইপার সেনসিটিভ) হয়। ওই ব্যথাটা কিছুক্ষণ থাকে, আবার চলে যায়। এ জন্য অনেক রোগীই সে সময়ে ডাক্তারের কাছে আসে না। তারা বলে যে ব্যথা নেই তো ডাক্তারের কাছে যাব কেন? ব্যথা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে, যেটি বড় বোকামি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অল্প চিকিৎসার মাধ্যমে যেই দাঁত রাখা সম্ভব হতো কিন্তু অনেক বাজে অবস্থায় নিয়ে আসার পর দাঁতটি আর রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের মধ্যে এখনো ধারণা রয়েছে যে দাঁত খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। ওই যে একটা প্রবাদ আছে না- দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা নেই!
প্রশ্ন : রোগীদের কখন আসলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া প্রয়োজন?
উত্তর : আসলে দন্ত্য চিকিৎসক বা ডেন্টিস্টদের কাছে ছয় মাসে অথবা বছরে একবার আসা উচিত, তাদের দাঁতগুলো ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ছোটখাটো সমস্যা থাকলে খুব সহজেই সারিয়ে নেওয়া যায়। ব্রাশ করার পরেও মাউথ ওয়াশের মাধ্যমে দাঁত পরিষ্কার করা ভালো। চিকিৎসকদের মাধ্যমে স্কেলিং করা জরুরি। মাড়ির প্রদাহগুলো স্কেলিংয়ের মাধ্যমে দূর করা সম্ভব।
প্রশ্ন : সমস্যা নির্ণয়ের পরে আপনাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হয়?
উত্তর : দন্ত্য চিকিৎসকদের কাজ হচ্ছে সঠিক সমস্যাটি নির্ণয় করা। রোগীটির কোথায় সমস্যা হচ্ছে সেটা বোঝা। অনেকে দেখা যায় নিউরালজিক পেইন নিয়ে চলে আসছে। সেই ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় খুব জরুরি। রোগ নির্ণয়ের জন্য এখন অনেক ভালো পদ্ধতি রয়েছে। বেশির ভাগ ক্লিনিকে এক্স-রে থাকে বা আমরা একটি ওটিজি এক্স-রে করে দেখতে পারি দাঁতের পুরো বিষয়টি। তখন ব্যথার উৎসটি কোথায় সেটি সহজেই বোঝা যায়।
প্রশ্ন : চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে কোন কোন বিষয়গুলোকে বেছে নেন?
উত্তর : গর্ত থাকলে সেটি ভরাট করে দিলে এর সমাধান হয় কি না। তারপরও যদি সমস্যা থাকে সেই ক্ষেত্রে আরেকটি অগ্রবর্তী পর্যায়ের চিকিৎসায় যাই- যেমন, রুট ক্যানেল। এটি আজকাল খুব প্রচলিত চিকিৎসা। দাঁতের যেই মজ্জার অংশটি থাকে সেটি যখন বাইরের কোনো কারণে নষ্ট হয়ে যায়, যখন প্রদাহ হয় সেই ক্ষেত্রে রুট ক্যানেল করে দাঁত না ফেলেও রক্ষা করা সম্ভব। রুট ক্যানেলের চিকিৎসার পরবর্তী সাফল্যও খুব ভালো। সেই ক্ষেত্রে রোগী ক্যাপ পরে দীর্ঘদিন থাকতে পারে। কোনো সমস্যা হয় না।
প্রশ্ন : ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিক ব্যথা সম্বন্ধে কিছু বলুন। এই রোগীরা ভাবছে তাদের দাঁতে ব্যথা, তাই একটির পর একটি দাঁত ফেলে দিচ্ছে তবুও ব্যথা সারেনি বা সঠিক দন্ত চিকিৎসকের কাছেও তারা যায়নি। এটি সম্বন্ধে কিছু বলুন...
উত্তর : ট্রাইজেমিনাল নিউরোলজিয়া আসলে একটি স্নায়ুতন্ত্রের রোগ। অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা বলে তার দাঁতে ব্যথা। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর বলে আমার এই দাঁতটি ফেলে দেন। আসলে এটি একটি নিউরোলজিক সমস্যা। এর সঙ্গে দাঁতে ব্যথার কোনো সম্পর্ক নাই। সে ক্ষেত্রে ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যেতে পারে। দাঁত ফেলা বা দাঁত রুট ক্যানেলের কোনো প্রয়োজন পড়ে না।
প্রশ্ন : রুট ক্যানেল চিকিৎসা নিয়ে অনেকের মধ্যে একটি ভীতি কাজ করে। এক বসা বা এক সিটিং-এ সব সময় ঠিক হয় না। বারবার আসতে হয়। তাই অনেকে ঝামেলার মনে করেন। তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী হবে? রুট ক্যানেল চিকিৎসার কার্যকারিতা কী? সেটি যদি দর্শকদের বলেন...
উত্তর : রুট ক্যানেলের ক্ষেত্রে রোগীদের মধ্যে যে ভয়টা কাজ করে তা হলো ব্যথার ভয়। তবে এটি ব্যথামুক্ত চিকিৎসা। কেননা চিকিৎসার প্রথমে আমরা নির্দিষ্ট অংশটিকে অজ্ঞান করে নিই। তারপর সেখানে কাজ করি। সে ক্ষেত্রে ব্যথা পাওয়ার আশঙ্কা থাকে না। বর্তমানে রুট ক্যানেল একদিনেও করা সম্ভব এবং খুব সফলভাবেই করা সম্ভব।
একটা বিষয় বলি। দাঁতে পাল্প খুব সূক্ষ্ম একটা জায়গা। দাঁতের মধ্যে যে চিকন একটা রুট বা শিকড় থাকে, সেটা দাঁতের নার্ভের মধ্য দিয়ে সরাসরি পাল্পে আসে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের ড্রিল মেশিন, রিমার বার ব্যবহার করি। এখন দন্ত্য চিকিৎসা অত্যন্ত আধুনিক। বিভিন্ন পদ্ধতিতে পাল্পগুলো ভালোভাবে দেখা যায়।
অনেকের ধারণা, দাঁতের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিন্তু মানুষের জীবনে দাঁতের যে প্রয়োজনীয়তা, সেটা অনেক বেশি। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে দাঁতের চিকিৎসায় খরচ অনেক কম, সাথে সহজলভ্যও। চিকিৎসা মানুষের হাতের নাগালে এবং ভালো মানের চিকিৎসা হচ্ছে এখন। আমি বলতে চাই, মানুষ যেন ছয় মাসে না হলেও বছরে একবার ডেন্টাল চেকআপ করে। তাহলে দীর্ঘদিন দাঁত সুস্থ রাখা সম্ভব।