কুম্ভকর্ণের মতো ঘুম হলে চিকিৎসা প্রয়োজন
প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণের মজার চরিত্র কুম্ভকর্ণের ঘুম নিয়ে আপনারা অনেক গল্পই হয় তো শুনেছেন। তেমনি একটি গালগল্প হলো, কুম্ভকর্ণ ঘুমের কারণে কথা স্পষ্ট করে বলতে পারতেন না। তাই দেবরাজ ইন্দ্রের বসার আসন- ‘ইন্দ্রাসন’ উচ্চারণ করতে গিয়ে তিনি বলে ফেলতেন ‘নিদ্র্রাসন’ (নিদ্রার জন্য আসন বা বিছানা)। আর এর জন্য নাকি দায়ী স্বয়ং দেবী সরস্বতী। কেন? তিনি নাকি কূম্ভকর্ণের জিহ্বা বেঁধে রাখতেন এবং তাঁকে দিয়ে ভুলভাল কথা বলাতেন। দেবী ভয় পেতেন যদি কোনোভাবে কূম্ভকর্ণ দেবদেবীদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলে তাহলে তো স্বর্গে আগুন লেগে যাবে! তাই দেবীর এমন কূটকৌশল প্রয়োগ!
মজার বিষয়, বিজ্ঞানীরা কুম্ভকর্ণের এই মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের রহস্য আবিষ্কার করেছেন। বা বলতে পারেন কেন মানুষ দিনের পর দিন ঘুমাতে পারে সেটার একটা সদুত্তর খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা। গবেষকরা জানান, যাদের হাইপোথেলামিক অবেসিটির সমস্যা রয়েছে তাদের এই লক্ষণ দৃশ্যমান হয়। মস্তিস্কের একটি নির্ধারিত অংশের হাইপোথেলামাসের অস্বাভাবিকতার কারণে এই সমস্যা হয়। মস্তিষ্কের এই অংশটি ক্ষুধাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব এন্ডোক্রিনোলজি অ্যান্ড মেটাবোলিজম’-এর নতুন সংখ্যায় প্রকাশিত এক জার্নালের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়া এই কূম্ভকর্ণ মার্কা ঘুমের ওপর মজার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।
জার্নালটির সহ লেখক ড. ওম জে লক্ষণী জানান, ‘এই অসম্ভব রকম ঘুমের পেছনে কারণ হতে পারে ব্রেইন টিউমার, যক্ষ্মারোগ কিংবা মস্তিষ্কে আঘাতজনিত সমস্যা।’
স্যার গঙ্গারাম হাসপাতালের এই এন্ড্রোকিনোলোজিস্ট ও চিকিৎসক আরো জানান, তিনি একজন ৫০ বছর বয়সী এক রোগী পেয়েছেন যার মধ্যে কুম্ভকর্ণের লক্ষণ রয়েছে। এই রোগী সারাদিন ঘুমায় এবং তখনই ঘুম ভাঙ্গে যখন তার ক্ষুধা লাগে। ঘুম থেকে উঠে খাবার না পেলে এই রোগী ভীষণ খেপে যান। এই লক্ষণ একেবারেই কূম্ভকর্ণের আচরণের সঙ্গে মিলে যায়। অবশ্য অস্ত্রপচার করে মস্তিষ্কের টিউমার অপসারণের পর এই রোগী এখন সুস্থ, তার অস্বাভাবিক আচরণ এখন দূর হয়েছে। আর ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়ম করে ওষুধও দেওয়া হচ্ছে।
পুরানের কাহিনী অনুযায়ী রাবণের ভাই কুম্ভকর্ণ দীর্ঘসময় ধরে ঘুমাতেন, তাঁকে জাগানো ছিল প্রায় অসম্ভবের সমান। আর যখন তার ঘুম ভাঙত তখন তার ভীষণরকম ক্ষুধা পেত আর চোখের সামনে যাই দেখতেন তাই খেতে শুরু করতেন গোগ্রাসে। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই তিনি আবার ক্লান্ত হয়ে পড়তেন এবং ঘুমের রাজ্যে ডুবে যেতেন। অবধারিতভাবেই তার ওজন বেড়েই যাচ্ছিল আর মেজাজও তাই দিন দিন তিরিক্ষি হচ্ছিল। কূম্ভকর্ণের মেজাজকে ভয় পেত না তেমন প্রাণী সে সময় খুঁজে পাওয়া ছিল বিরল।
সাম্প্রতিক জার্নালের লেখকদের দাবি, কূম্ভকর্ণের যত রকম সমস্যা ছিল সেগুলোর সবই নির্দেশ করছে এই ধরনের সমস্যা হবে হাইপোথ্যালামিক অবেসিটি থাকলে। তাঁরা বলেন, ‘আগের গবেষণায় এই ধরনের সমস্যার পেছনে হাইপোথাইরয়েডিজম বা স্লিপ অ্যাপনিয়াকে দায়ী করা হয়েছিল। আমরা বিশ্বাস করি শুধু হাইপোথাইরয়েডিজম দিয়ে এই সমস্যার ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয় যেহেতু হাইপোথাইরয়েডিজমের সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত ওজন বা ওবেসিটির সম্পর্ক আছে, যোগ আছে ক্ষুধামন্দার।’ জার্নালের ওই নিবন্ধে আরো বলা হয়, ‘হাইপোথ্যালামিক অবেসিটিতে কপট রাগ বা ক্রোধের বিষয়টি রয়েছে এবং এই বৈশিষ্ট্যও মিলে যায় কূম্ভকর্ণের চরিত্রের সঙ্গে।
লেখকরা নিবন্ধে বলেন, ‘বাল্মীকির রামায়ণে একপর্যায়ে দেখা যায় ভাইয়ের সমন পেয়ে জেগে ওঠার পর দুই হাজার কলস পানি তিনি ঢকঢক করে গলায় ঢেলেছিলেন। পলিডিপসিয়া হলো ডায়াবেটিসের একটি অতিচেনা লক্ষণ, আর এটি হাইপোথ্যালামিক অবেসিটির একটি বৈশিষ্ট্য। কূম্ভকর্ণের সমস্যা নিয়ে যেসব রোগী চিকিৎসকের কাছে আসে তাদের ৩০ শতাংশেরই এই সমস্যা রয়েছে। কূম্ভকর্ণের মতো এ রকম ক্লান্তি শরীরে কম শক্তিশালী বিপাক প্রক্রিয়া থাকলে, হরমোনের সঠিক বিস্তার না ঘটলে, থাইরয়েড হরমোন ও গোনাডোট্রপিন্সের (পিটুইটারি গ্লান্ডে এসব হরমোন উৎপন্ন হয়) ঘাটতি হলে হতে পারে।’