কী করলে ভালো থাকবে ত্বক?
সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর ত্বক সবার কাম্য। আর এই সুন্দর ত্বক পেতে কী করা প্রয়োজন, এ বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৫৭৭তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. তাওহীদা রহমান ইরিন। বর্তমানে তিনি শিওর সেলের ডার্মাটোলজি বিভাগে বিভাগীয় প্রধান ও পরামর্শক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : অত্যাধুনিক ত্বকের যত্ন বলতে আসলে কী বোঝানো হয়?
উত্তর : ত্বকের সুস্বাস্থ্যে ও সৌন্দর্যে যত্নের সঙ্গে পুষ্টির ভূমিকা অপরিসীম। আর এ ক্ষেত্রে আমরা যোগ করেছি অ্যাডভান্সড বা অত্যাধুনিক যে চিকিৎসা, সেগুলোর সংযোজন। সেই ক্ষেত্রে মূল ত্বকের যত্ন থাকবে। সেখানে পুষ্টি থাকবে, সেই সঙ্গে উন্নত চিকিৎসা থাকবে। অনেকে হয়তো ভেবেছে এসব চিকিৎসা হয়তো শুধু উন্নত বিশ্বে গিয়ে সম্ভব। আসলে তা নয়। এসব চিকিৎসা এখন আমাদের দেশে এসেছে।
প্রশ্ন : বাইরের দেশে ত্বকের যত্নে যেসব চিকিৎসা রয়েছে, সেগুলো সবই কি আপনারা বাংলাদেশে আনতে পেরেছেন?
উত্তর : প্রথমে আমি এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিই, মালয়সিয়া, সিঙ্গাপুর ও ফ্রান্সে। তিনটি দেশেই আমি প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর যা দেখেছি, যে কেউ যখন কোনো সমস্যা নিয়ে আসে, সৌন্দর্য বাড়াতে চায় বা বয়সের গতিকে একটু ধীর রাখতে চায়, সেক্ষেত্রে তারা যা করে আমি সেগুলো দর্শকদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। কারণ, এ প্রক্রিয়াগুলো আমাদের দেশে সহজেই পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে প্রথমে তারা অ্যালার্জি প্যানেল টেস্ট করেন। সে ক্ষেত্রে কী কী থাকছে? কোন কোন খাবার সে গ্রহণ করতে পারবে, কোন কোন খাবার সে গ্রহণ করতে পারবে না। এর পরে আসছে পণ্য। ত্বকের যত্ন আমরা যে প্রসাধনী বা পারফিউম ব্যবহার করি, সেগুলোর কোন উপাদানগুলো ত্বকের জন্য উপযোগী, কোনগুলো ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। সে ক্ষেত্রে একটি তালিকা করে দেওয়া হচ্ছে। এরপর রয়েছে, ধুলাবালি। বাতাসে জীবাণু, নানা ধরনের ফাঙ্গাস, ব্যাকটেরিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে অদৃশ্য হয়ে। সেগুলো ত্বকের কী কী ক্ষতি করছে। এরপর আসছে পোষা প্রাণী, অনেকে তো কুকুর, বিড়াল, পাখি পছন্দ করে। সেগুলোর কোনো পশম বা লালা কতখানি ক্ষতিকর, সেগুলো বের করছে। এরপর আমরা যে কাপড় পরি, এর কোনো ধরনের ফেব্রিক, আমাদের ত্বকের জন্য উপযোগী। এই সবকিছু মিলিয়ে তারা একটি তালিকা করে দিচ্ছে। এর সঙ্গে তাদের ওজন দেখা হচ্ছে। এখানে তার শরীরের চর্বির পরিমাণ, তার আর্দ্রতা ব্যবস্থপনা, কী পরিমাণ তরল রয়েছে এবং হাড় ও পেশির পুরুত্ব ও ঘনত্ব কতখানি, সেগুলো দেখে তাকে একটি ডায়েট চার্ট করে দেওয়া হচ্ছে। পণ্যের চার্ট করে দেওয়া হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সে বুঝতে পারছে, কোন পণ্যটি ব্যবহার করবে, কোন খাবারটি খাবে এবং কোনগুলো একেবারেই এড়িয়ে যাবে। একে আমরা হলিস্টিক এপ্রোচ বলি।
এখানে তার শারীরিক, মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে প্রতিটি অঙ্গের সুস্থতা খেয়াল করা হয়। এ ক্ষেত্রে একটি ল্যাব দরকার, একটি জিম দরকার এবং আপনার একজন ডার্মাটোলজিস্ট ও পুষ্টিবিদের প্যানেল দরকার। আর সঙ্গে যদি অন্যান্য কোনো রোগ থাকে, সেগুলো ঠিকঠাক করার জন্য বিশেষজ্ঞ দরকার।
প্রশ্ন : ত্বকের দৈনন্দিন যত্ন কীভাবে হতে পারে?
উত্তর : দর্শক ও আমার সুবিধার জন্য আমি রুলস অব সেভেনে সাজিয়েছি। সাতটি নিয়ম রয়েছে। এখানে প্রথমে আসছে, পরিচ্ছন্নতা। আমাদের মুখের ত্বক ও শরীরের ত্বক দুই ধরনের। অনেকে মুখে যে ফেইস ক্লিনজার ব্যবহার করে, সেটি আবার শরীরে ব্যবহার করে। এটা করা যাবে না। আবার অনেকে শরীরে যেটি ব্যবহার করছে, সেটি মুখে ব্যবহার করছে। চুলের জন্য আলাদা শ্যাম্পু, মুখের জন্য আলাদা ক্লিনজার এবং শরীরের জন্য আলাদা সাবান ব্যবহার করতে হবে।
এরপর আসছে ময়েশ্চারাইজেশন। ত্বকের কিন্তু একটি প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার ফ্যাক্টর থাকে। সিবাসিয়াস গ্রন্থি থেকে নিঃসরণ হয় প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার ফ্যাক্টর। সেগুলোর সঙ্গে দরকার বাড়তি আর্দ্রতা। আর সামনে তো শীত আসছে। শীত মানেই শুষ্কতা। সেক্ষেত্রে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে। সেটিও ত্বকের ধরন অনুযায়ী। মুখ ও সম্পূর্ণ শরীরের ময়েশ্চারাইজার আলাদা। মুখমণ্ডলে ঠোঁটের ময়েশ্চারাইজার আলাদা হবে এবং আইক্রিম আলাদা হবে। আর সম্পূর্ণ শরীরের কিছু কিছু অংশ একটু শুষ্ক থাকে। যেমন : পায়ের তালু ও কনুই। এখানকার ময়েশ্চারাইজারগুলো একটু পাতলা, একটু ক্রিমি ধরনের হতে হবে। যেখানে সেরামাইড, প্যাপটাইড, মিডিয়াম চেইন ফ্যাটি এসিড থাকবে। এগুলো নারকেল তেল, ভ্যাসলিন বা পেট্রোলিয়াম জেলিতেও পাওয়া যায়।
প্রশ্ন : সহজে পাওয়া যায় এমন কোনো পণ্য রয়েছে কি যাতে ত্বক ভালো থাকে?
উত্তর : সামনে শীত আসছে, শীতে শুষ্কতা ভয়াবহ রূপে দেখা দেয়। অনেকের ক্ষেত্রে এটি আতঙ্ক। নারকেল তেলে মিডিয়াম চেইন ফ্যাটি এসিড, কেপরিক এসিড ও লোয়ারিক এসিড থাকে। এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। নারকেলের দুধ ময়েশ্চারাইজার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
এরপর তিন নম্বর, এখানে সূর্যের থেকে সুরক্ষাকারী ক্রিম বছরজুড়ে ব্যবহার করব। এরপর আসছে ওরাল সানস্ক্রিন। একটি নতুন ধারণা। এগুলো হলো, উচ্চ অ্যান্টি অক্সিডেন্টযুক্ত সাপ্লিমেন্ট। এগুলো সূর্যের আলো থেকে ত্বককে রক্ষা করে, ত্বকের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দেয় এবং বয়সের গতিকে কমিয়ে দেয়। এগুলোকে আমরা ওরাল সানস্ক্রিন বলি। আমাদের দেশে এখন এই ধারণাটি এসেছে।
এরপর, খাবার-দাবার। এই খাবারের মধ্যে আমি বলি ত্বক উজ্জ্বলকারী খাবার এবং এর সঙ্গে কার্ব, প্রোটিন, স্বাস্থ্যকর চর্বি, ভিটামিন, মিনারেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রশ্ন : ত্বক ভালো রাখার জন্য কতটুকু কার্বহাইড্রেট খাওয়া উচিত?
উত্তর : একে আমরা বলি, কোয়ালিটি কার্ব, কমপ্লেক্স কার্ব। আমরা সিম্পল কার্ব খাবো না। কমপ্লেক্স কার্ব খাবো। সেটি কার মধ্যে রয়েছে? মিষ্টি আলু, কাউন, বাদামি চাল ও শস্য দানা। এগুলো আমাদের শরীরে ডিটক্সিফায়ার ( বিষাক্ত পদার্থ দূরকারী) হিসেবে কাজ করে। মানে, আমরা খাবারের মাধ্যমে যে প্রিজারভেটিভ, রাসায়নিক নিচ্ছি বা মানসিক চাপের কারণে যে টক্সিন হয়, এ ধরনের খাবার সেগুলো দূর করতে সাহায্য করে। রক্ত পরিশোধিত হতে সাহায্য করে। আর কার্বের অভাবে ত্বক নির্জীব হয়ে যায়। কার্ব তো আমাকে শক্তি দিচ্ছে। তবে বুঝে নিতে হবে কোন ধরনের কার্ব খাবো।
বাদামি চাল এখন সুপার মার্কেটে পাওয়া যায়। গ্রামের ঢেঁকি ছাটা চালও অনেক ভালো। গম থেকে যে লাল আটার রুটি সেগুলোও কিন্তু উপকারী। ঢেঁকিছাটা চাল খাবে, বাদামি রুটি খাবে। সাদা চাল, সাদা চিনি কিন্তু ক্ষতিকর কার্ব।
প্রশ্ন : আর কী কী বিষয় রয়েছে ত্বক ভালো রাখার জন্য?
উত্তর : ত্বকে যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়, আমি নিজে নিজে চিকিৎসা না করে চিকিৎসকের কাছে যাবো। অনেক ক্ষেত্রে কিন্তু আমরা বছরে একবার একজন ডার্মাটোলজিস্টকে দেখাতেই পারি।
এই নিয়মগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পর্কিত। খাবারের প্রতিটি উপাদানই আমাদের ত্বকে জন্য, সুস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। এই ক্ষেত্রে ভিটামিনের মধ্যে সানসাইন ভিটামিন, যাকে আমরা বলি, ভিটামিন ডি, এটি কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ আমাদের শরীরের জন্য। ভিটামিন ডি-এর অভাবে ত্বক শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে। নানা ধরনের রোগ হচ্ছে। যেমন : এক্সিমা, এটোপিক ডার্মাটাইটিস, সোরিয়াসিস হচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি রয়েছে কি না, সেটি পরীক্ষা করতে হবে। সে অনুযায়ী সাপ্লিমেন্ট নিতে হবে। এরপর আসে স্বাস্থ্যকর চর্বি। স্বাস্থ্যকর চর্বির মধ্যে রয়েছে ওমেগা ৩ ও ওমেগা ৬। যেমন : মাছ। এতে ওমেগা ৩ ও জিংক থাকে। তিল ও তিশি- এগুলোতে প্রচুর পরিমাণ স্বাস্থ্যকর চর্বি থাকে। আরেকটি স্বাস্থ্যকর চর্বি হলো, নারকেল। এখানে প্রচুর পরিমাণে মিডিয়াম চেইন ফ্যাটি এসিড থাকে। তো আমি যদি একদিন পরপর ১০ গ্রাম করে নারকেল খাই, এই শীতে, তাহলে কিন্তু শুষ্কতা অনেকখানি কমিয়ে আনতে পারব। অবশ্য এটি সুস্থ প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য। সঙ্গে এখন নারকেলের সাপ্লিমেন্টও বাংলাদেশে পাওয়া যায়।
প্রশ্ন : ত্বক ভালো রাখার জন্য ব্যায়ামের ভূমিকা কী?
উত্তর : ব্যায়াম করলে রক্ত সঞ্চালন বাড়বে। আপনার মাংসপেশি সচল থাকবে, হাড়ের ঘনত্ব বাড়বে। সেই সঙ্গে ভালো অনুভূতির হরমোন, ডোপামিন ও সেরোটোনিন ভারসাম্য পাবে। আর আপনার ঘুমও ভালো হবে।
প্রশ্ন : আমাদের দেশে ত্বকের অত্যাধুনিক চিকিৎসার খরচ আসলে কেমন?
উত্তর : অত্যাধুনিক চিকিৎসার নিয়মের মধ্যে আরেকটি রয়েছে, আমি নতুন চিকিৎসায় কী পদ্ধতি এনেছি। যেমন : পিআরপি ও স্টেম সেল। যাদের ত্বক নির্জীব, বয়সের গতি অন্যদের তুলনায় বেড়ে যাচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে এটি। ত্বকের একটি সৌন্দর্য বর্ধক উপাদান কোলাজেন। এটি আমাদের সম্পূর্ণ শরীরের ৩০ শতাংশ প্রোটিন ধারণ করে। এই কোলাজেনকে বাড়ায় পিএপিআরপি। ফটো একটিভেটেট প্লাটিলেট রিচ প্লাজমা। এটি আমাদের মুখের ত্বক, চুলের স্বাস্থ্য, হাতের ত্বক, গলার ত্বককে ঠিক করতে পারে। পিআরপি এর খরচ এক রকম। আর সম্পূর্ণ অত্যাধুনিক চিকিৎসা যদি নিতে চায়, অ্যালার্জি প্যানেল টেস্ট, ব্যায়াম বা বিশ্রামের জন্য সে কতখানি ঘুমাবে বা কী খাবে, এগুলো দেওয়া হয়। এখানে আসলে নমনীয়। যার যেমন দরকার তেমনি।
প্রশ্ন : সার্বিকভাবে ত্বককে ভালো রাখার জন্য কী করণীয়?
উত্তর : সাতটি নিয়ম মেনে চলা। পরিমিত আহার, বিশ্রাম ও সঙ্গে ব্যায়াম। আর অত্যাধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা তো আমরা নিয়েই এসেছি।