বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে করণীয়

Looks like you've blocked notifications!
বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কথা বলেছেন তসলিমুদ্দিন খান ও ডা. সাখাওয়াৎ হোসেন। ছবি : সংগৃহীত

আজ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। বাংলাদেশে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে করণীয় কী?

এ বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৪৮৮তম পর্বে কথা বলেছেন দেশের খ্যাতনামা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানির চিফ অব প্রোগ্রাম অপারেশন তসলিমুদ্দিন খান।

এনটিভি : বাংলাদেশে এ মুহূর্তে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কোন পর্যায়ে রয়েছে?

তসলিমুদ্দিন খান : এ আলোচনার শুরুতে সবার কাছে তথ্য শেয়ার করে আলোচনাটা করতে চাই। আজ থেকে ৪৫ বছর আগে, আমরা যখন স্বাধীন হই, তখন তৎকালীন জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি। পশ্চিম পাকিস্তানে সেই সময় জনসংখ্যা ছিল ছয় কোটির মতো। এই এক কোটি জনসংখ্যা বেশি নিয়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। আমরা যাত্রা শুরু করি। আপনি জেনে খুশি হবেন, পাকিস্তানের জনসংখ্যা হলো, ২১ কোটি। আর বাংলাদেশের জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটি বা ১৬ কোটি। এই যে জনসংখ্যার একটি বিশাল ব্যবধান, বাংলাদেশে যদি আরো পাঁচ থেকে ছয় কোটি জনসংখ্যা বেড়ে যেত, তাদের খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান, আশ্রয় সবকিছু নিয়ে কিন্তু আমরা একটি বিরাট সমস্যায় পড়ে যেতাম। এখন এটি কীভাবে সম্ভব হয়েছে?

এনটিভি : এই যে এত বড় সফলতা এটি কীভাবে সম্ভব হলো?

তসলিমুদ্দিন খান : বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির যে সাফল্য, সেটি ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনার সাফল্যগাঁথা এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আলোচিত হয়। বাংলাদেশে অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমাদের আর্থিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, শিক্ষার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর মধ্যেও আমাদের যে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সেটি কিন্তু অনেক সাফল্য লাভ করেছে। বাংলাদেশে প্রজননক্ষম ৬২ জন দম্পতিই পরিবার পরিকল্পনার ভেতরে রয়েছে। এটি একটি বিরাট বিষয়। আপনি যদি তিন দশক আগের কথাও চিন্তা করেন, তখন এটি ১৫ থেকে ১৬ ছিল। এই যে বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির অগ্রগতি, আমরা একে বলি টিএফআর। অর্থাৎ টোটাল ফার্টিলেটি রেট। অর্থাৎ একজন প্রজননক্ষম নারী, তার প্রজননের সময়ের মধ্যে কতটি সন্তান জন্ম দেয়। এটিও একটি সুখকর তথ্য, সুখকর অভিজ্ঞতা। বর্তমানে প্রজননক্ষম নারীর সন্তান প্রদানের গড় হলো, দুই দশমিক তিন। আজ থেকে ৩০ থেকে ৪০ বছর আগেও এটি ছিল ছয়ের মতো। এই যে একটি ব্যবধান, একটি বিরাট সাফল্য আমরা অর্জন করেছি। এ কারণে দ্রুত গতিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি।

এনটিভি : জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে যেসব বাধা ছিল, সেগুলো অতিক্রম করলেন কীভাবে ?

তসলিমুদ্দিন খান : অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আপনি করেছেন। সোশ্যাল মাকেটিং কোম্পানি, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭৪ সালে যখন জন্ম লাভ করে এবং বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি শুরু করেন। যখন আমরা পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি প্রথম দিকে শুরু করি, তখন শিক্ষার অবস্থা এমন ছিল না, তারা একে ধর্মীয় অনুশাসনের সঙ্গে সমৃক্ত করে ফেলত এবং বিভিন্ন রকম বাধা ছিল। ধর্মীয় বাধাগুলো অতিক্রম করার জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছে সরকারি পর্যায়ে, বিভিন্ন দাতা গোষ্ঠী তাদের সাহায্য করছে। বিশেষ করে একটি দাতা গোষ্ঠীর কথা না বললেই নয়, ইউএসআইডি। তারা প্রচুর সমর্থন জুগিয়েছে, সহায়তা করেছে। এমনকি এসএমসিও কিন্তু নিরবচ্ছিন্নভাবে এ কাজে সাহায্য করে আসছে। এই যে তাদের সমগ্র সামগ্রিক প্রচেষ্টা, জনস্বাস্থ্যের একজন কর্মী হিসেবে যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির কেন এ সফল হয়েছে, আমি এক কথায় বলি, সাফল্যের জন্য সরকারি নীতিমালা সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে। কেমন? সরকার শুরুতেই উপলব্ধি করতে পেরেছে, যে এ কর্মসূচি সরকারের একার প্রচেষ্টায় সম্ভব নয়। বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি চালানোর জন্য সরকারিভাবে নীতিমালা রয়েছে। এ নীতিমালাকে  সম্মিলিতভাবে বেসরকারি পর্যায়ে, সরকারি পর্যায়ে, এনজিও পর্যায়ে, সরকার সবাইকে সম্পৃক্ত করেছে। আজকের পরিবার পরিকল্পনার সাফল্য বা জনসংখ্যা যতটুকু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, এই যে সাফল্য এটি এসেছে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। সরকার কাজটি এমনভাবে করেছে যে এই কর্মসূচির সঙ্গে যেন সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিকে কেবল ফ্যামিলি প্ল্যানিং হিসেবে চিন্তা করলে হবে না। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি কিন্তু স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটায়। এটি শিশুমৃত্যু রোধ করে। আমরা এভাবে যদি ধরি, যদি বেশি সন্তান একজনের হয়, ১৮ বছরের নিচে যদি সন্তান হয় এবং দুই সন্তান যদি তিন বছরের ব্যবধানে না হয়, তাহলে শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার বাড়ে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সঙ্গে শিশু মৃত্যু ও মাতৃমৃত্যু ওতপ্রোতোভাবে জড়িত। এ দুটো বিষয় কমানোর ক্ষেত্রেও কিন্তু অনেক সাফল্য এসেছে।

এনটিভি : জনসংখ্যা বাড়লে কী সমস্যা হয়? একে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কী করণীয়?

তসলিমুদ্দিন খান : এতক্ষণ কিন্তু আমরা সাফল্যের কথা বলেছি। সম্ভাবনা রয়েছে, তবে এর সঙ্গে সমস্যাও রয়েছে। এ সমস্যাগুলোই আমাদের এখন আলোচনা করা দরকার। দেখুন, বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির ক্ষেত্রে বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো, বাল্যবিবাহ। অর্থাৎ আমাদের একটি কর্মসূচি রয়েছে, একে আমরা বলি ১৮, ২০, ৩৫, তিন। ১৮ বছর কিন্তু বিয়ের বয়স। আইনগতভাবে এটি স্বীকৃত। তবে  শতকরা ৬০ জন বয়োসন্ধির ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এটা হয়তো প্রকাশ করছি না। তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে তখন পাই। বিয়েটা কিন্তু শেষ নয়। শ্বশুরবাড়ির চাপ রয়েছে। বিয়ের পর দ্রুত গর্ভবতী হয়ে যাচ্ছে। আমরা বলি, ১৮ বছর বয়সের আগে তো বিয়ে নয়ই, ২০ বছরের আগে সন্তান নয়। ২০ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এবং গর্ভবতী হয়ে যাচ্ছে। এতে কী হচ্ছে? ওই পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির মধ্যে যেহেতু তারা নেই, সে ক্ষেত্রে সন্তানও বেশি হয়ে যাচ্ছে। বয়ঃসন্ধিতে তারা রিপ্রোডাকটিভ সাইকেলিংয়ের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। এই যে একটি অবস্থা, একে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। এর কারণ হলো, বয়ঃসন্ধিতে তার প্রজনন চক্রের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। সচেতনতা আনা দরকার, যেন বাল্যবিবাহ কম হয় এ বিষয়ে।

একদিকে যেমন তারা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে, বিয়ের পরে, আরেকদিকে কিন্ত জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। তো এ বিষয়টিকে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবার পরিকল্পনার কিন্তু বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। স্বল্পমেয়াদি পদ্ধতি রয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী পদ্ধতি রয়েছে। এখন আমরা বিভিন্নভাবে গবেষণা করে দেখেছি, দম্পতি যদি অন্তত পাঁচ বছর দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি ব্যবহার না করে তারা কনট্রাসেপটিভ ফেইলিউর হয়ে যেতে পারে এবং তারা আবার গর্ভবতী হয়ে যায়। এই জন্য আমরা বলি দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি ব্যবহার করার জন্য। যেমন, আইওডি, প্ল্যান্ট পদ্ধতি রয়েছে, এগুলো করতে বলি।

এনটিভি : একটি দম্পতি, গ্রামাঞ্চলে জন্মনিয়ন্ত্রক পদ্ধতি গ্রহণ করতে চাইলে কোথায় যাবে?

তসলিমুদ্দিন খান : আমি সেখানে আসব। এই যে দীর্ঘমেয়াদি পরিবার পরিকল্পনা, বাংলাদেশে হয়তো সেটি আট ভাগ। আমরা সরকারি নীতিমালায় বলি, ২০২২ সালে একে ২০ ভাগে নিয়ে যেতে হবে। তাহলে কীভাবে করতে হবে? তাহলে সরকারি সেক্টরকে কাজ করতে হবে, সরকারকে কাজ করতে হবে। সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। আমরা সোশ্যাল মাকেটিং কোম্পানি বিভিন্নভাবে এ স্থায়ী পদ্ধতির বিষয়ে প্রমোশন করি। বাংলাদেশের যারা গাইনোকোলোজিস্ট তাদের নিয়ে আমরা একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছি। প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষতা বাড়ানোর বিষয়ে কাজ করি এবং আমাদের একটি নিজস্ব ব্র্যান্ড রয়েছে, আমরা তাদের দেই, তারা এই সেবাটা দেয়। এই এলএআরসি প্রোগ্রামটা তারা ছয়/ সাত বছর আগে কল্পনায় আনতে পারত না। এখন কিন্তু তারা পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন চাই, এলএআরসির জন্য একজন রোগী গাইনোকোলোজিস্টের কাছে যাবে। এই কর্মসূচিটা এখন অনেকখানি এগিয়ে গেছে। সরকারি পর্যায়েও প্রচুর প্রচারণা চালানো হয়েছে। নতুন নতুন চিন্তা কর্মসূচির মধ্যে আসছে। সেটি হলো আইওডি। আমরা এখন চাই, বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পরই একটি রোগী একটি আইওডি বা ইমপ্ল্যান্ট নিয়ে যাক।

ওরাল কনট্রাসেপটিভ পিল যতটা দেওয়া হচ্ছে, এর ৪৫ ভাগ শেয়ার, এসএমসি থেকে হচ্ছে। অর্থাৎ সরকারি প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে এসএমসিও তার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

এনটিভি : আদর্শগতভাবে ঘনত্ব অনুযায়ী জনসংখ্যা কতটুকু? এটি আমাদের দেশে কোন পর্যায়ে রয়েছে? কোন পর্যায়ে আমরা নিতে চাই?  

তসলিমুদ্দিন খান : আসলে আমরা সবাই জানি, সার্বিকভাবে বনায়ন কতটুকু থাকা উচিত, নগরায়ন হলে কতটুকু সড়ক থাকা দরকার। কতগুলো স্কুল থাকা দরকার, এর কিন্তু এখনো অনেক পিছনে আমরা রয়েছি। আমরা সমস্যা নিয়ে শুরু করেছি, সমস্যার অনেকটা সমাধান করেছি। তবে লক্ষ্যে পৌঁছুতে যোজন যোজন দূরত্ব পার হতে হবে।

এনটিভি : আমাদের লক্ষ্যটা কী?

তসলিমুদ্দিন খান : একে আমরা বলি, রিপ্লেসমেন্ট ডেভেলপ ফার্টিলিটি। একে দুইয়ে নামিয়ে আনতে হবে। তবে দুইয়ে নামিয়ে আনলে কিন্তু জনসংখ্যা স্থিতিশীল হবে না। কেন হবে না?  আমাদের জনসংখ্যার মধ্যে তরুণ অনেক বেশি। যারা কম বয়স্ক তাদের সংখ্যা বেশি। তাদের বিয়ে হবে, জনসংখ্যা বাড়বে। রিপ্লেসমেন্ট ফার্টিলিটি যদি এক পর্যায়ে হয়েও যায়, তাহলেও কিন্তু জনসংখ্যা বাড়বে। আমাদের একে ধারণ করেই চলতে হবে। কিন্তু তার পর যখন জনসংখ্যা স্থিতিশীল হবে,  তখন সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করতে হবে। এখন দরকার যারা পরিবার পরিকল্পনার দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের বোঝা যে আসলে আমরা কোথায় গিয়ে থামব। সেই অনুযায়ী সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা করতে হবে।