রোজায় সুস্থ থাকতে মেনে চলুন এসব বিষয়
চলছে রমজান মাস। রোজার সময় পেটের পীড়া, মাথাব্যথা, পানিশূন্যতা, ক্লান্তিভাব, বদহজমসহ শারীরিক বিভিন্ন জটিলতা দেখা যায়। তাই সুস্থভাবে রোজা রাখতে কিছু বিষয় মেনে চলা জরুরি।
সুস্থভাবে রোজা রাখাতে পরামর্শ জানিয়েছে অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৪৫৫তম পর্বে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়।
প্রশ্ন : রোজার সময় সুস্থ থাকতে কোন বিষয়গুলো মনে রাখা উচিত?
উত্তর : আসলে সত্যিকারের সিয়াম যদি আমরা পালন করি, এই সময় অসুখ থাকার কথা নয়। কিন্তু আমরা কিছু বাড়াবাড়ি করে ফেলি। একটু সাধারণভাবে চিন্তা করেন, আপনি এ সময় হালিম খাচ্ছেন, ভাজাপোড়া খাচ্ছেন। আমরা সাধারণত কী খাচ্ছি? ডাল, ভাত, মাংস, শাক-সবজি খাচ্ছি। রোজার মাসে কিন্তু এসব খাবারগুলো আমাদের ম্যানু থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। যত তৈলাক্ত খাবার রয়েছে সব চলে আসছে।
এখন যে প্রধান সমস্যা সেটি হলো গরম। এ গরমে সবচেয়ে বেশি ভয়ের জিনিস হলো পানিশূন্যতা। তাহলে আমাকে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। অপ্রয়োজনে আমরা রোদে ঘোরাফেরা করব না। যদি আমাকে বের হতে হয়, আমি ছাতা ব্যবহার করব। অথবা হালকা কাপড় পরব। সিনথেটিক কোনো কাপড় আমি পরব না। আমি সুতির পোশাক ব্যবহার করব।
ইফতার ও সেহরিতে যতটুকু সম্ভব পানি পান করব। আমি সঙ্গে একটু ওরস্যালাইন নিতে পারি। যতটুকু সম্ভব ফল খাওয়ার জন্য চেষ্টা করব। শাক-সবজি খেতে চেষ্টা করব। মাছ- মাংস তো খেতেই হবে। তবে আমরা চেষ্টা করব যতটুকু সম্ভব তেল জাতীয় খাবার না খেতে।
আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একটি কথা বলি। তেলযুক্ত খাবার হলো স্পেসিফিক ডায়নামিক অ্যাকশন অব দ্যা ফুড। আপনি যখন একটি কার্বহাইড্রেট খাবার গ্রহণ করবেন, তাকে হজম করতে গিয়ে শরীরে চার কিলোক্যালোরি তাপ উৎপাদন হচ্ছে এক গ্রামের জন্য। যখন আপনি তৈলাক্ত খাবার খাবেন, তখন এটি হয়ে যাবে ৯০ কিলোক্যালোরি। যেদিন আমরা প্রচুর ভারী খাবার খেয়ে আসি, বিরিয়ানী খেয়ে আসি, দেখা যায়, রাতে ঘুমিয়েও আমরা ঘামছি। এসি ছেড়েও ঘাম হচ্ছে। এর মানে আমরা যদি রোজার মধ্যে আমাদের খাদ্যাভ্যাসকে ওই দিকে নিয়ে যাই, শরীর থেকে প্রচুর তাপ বের হবে, শরীর পানিশূন্য হয়ে যাবে। আমি কিন্তু আমার নিজের হাতে নিজের ক্ষতি করছি। আমারও আহ্বান থাকবে আপনাদের প্রতি যতটুকু সম্ভব ভারী খাবার এড়িয়ে গিয়ে স্বাভাবিক খাবার খান। ফলমূল যতটুকু সম্ভব বাড়িয়ে নেব, যদি আমার এগুলো খাওয়ার প্রতি কোনো অসুবিধা না থাকে।
প্রশ্ন : যাদের গ্যাসট্রিকের সমস্যা রয়েছে, তারা কোন কোন বিষয় মাথায় রাখবেন, এই সময়ে?
উত্তর : আসলে আলসার হলো দুই ধরনের। একটি পাকস্থলীতে হয়। এটি হলো, গ্যাসট্রিক আলসার। আরেকটি হলো ডিওডেরান আলসার। ডিওডেরান আলসারের ক্ষেত্রে আমরা বলি নো এসিড, নো আলসার। আর গ্যাসট্রিকের ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে বাংলাদেশের যতগুলো লোকের আমরা গ্যাসট্রিক বলে দাবি করি, বেশিরভাগই ইরিটেবল বাউয়েল সিনড্রমে ভুগছে। কারণ, আমরা কম-বেশি সবাই একটি দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকি। দুশ্চিন্তার কারণে আইবিএস তৈরি হচ্ছে। তৈলাক্ত খাবার যদি আপনি খান, আইবিএসটা কিন্তু আরো বেড়ে যাবে। যাদের আসলেই আলসার রয়েছে, তারা যদি আলসারের জন্য ওষুধ খায়, তাদের রোজায় কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
প্রশ্ন : রোজার সময় ওষুধটা তাদের কীভাবে খেতে হবে?
উত্তর : গ্যাসট্রিকের বেশিরভাগ ওষুধ রয়েছে যেগুলো খালিপেটে খেতে হয়। ইসমোপ্রাজলটা খালি পেট বা ভরা পেট নেই, সবসময় খেতে পারি। বা খালিপেটের ওষুধগুলোতে আমরা সবাইকে এভাবে বলি, বিশেষ করে ডায়াবেটিসের যারা রোগী রয়েছে, তাদের বলি, আপনি রোজাটা ভাঙবেন আগে, কখনোই ইনসুলিন নেবেন না। কেন দেবেন না? আমি একটি ইনসুলিন দিয়ে বসলাম, আজান দিচ্ছে, হঠাৎ করে দুঃসংবাদ আসল, আমার খুব নিকট আত্মীয় মারা গেছেন, আমি কি খাওয়ার টেবিলে বসে বসে ইফতারিটা শেষ করব, না কি খুব কাছের যে মানুষ মারা গেলেন, সেখানে চলে যাব। আমি তাই পরামর্শ দিই, মুখে হালকা খাবার দেন, এবার ইনসুলিন নেন অথবা আপনি ওষুধটা খেয়ে নেন, এবার নামাজ পড়তে চলে চান। নামাজ পড়ে এসে ধীর স্থিরভাবে আপনি এবার খান।
সারা দিন আমি না খেয়ে আছি, আমি তাকে ইনসুলিন দিয়ে দিচ্ছি, তার মধ্যে তার খাওয়াটা বন্ধ করে দিলাম, কীভাবে হবে।
প্রশ্ন : আপনি কি মনে করেন একজন চিকিৎসকের কাছে গিয়ে রোজার আগে ওষুধের ডোজটা ঠিক করে নিতে হবে?
উত্তর : অবশ্যই। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে আমরা রমজানে সেহরির ডোজটাকে অনেক কমিয়ে নিয়ে আসি। ইফতারের ডোজ কিছুটা কমানো হয়। সকালের ডোজটা আমরা প্রধাণত নিয়ে যাই ইফতারিতে। কারণ, আমাদের যত খাবার রয়েছে সব ইফতারি থেকে সেহরি পর্যন্ত। এরপর লম্বা সময় ধরে একটি না খাওয়ার বিষয় থাকে।
প্রেশারের ওষুধের কথাও যদি বলি, আমি ইফতারিতে খেতে বলি। এই জন্য বলি যে অনেক সময় আমরা সেহরির সময় উঠতেই পারলাম না। ঘড়ির অ্যালার্মটা বাজল না। তাহলে কিন্তু আমার সেদিনের ওষুধটা বাদ পড়ে যাচ্ছে। যার প্রেশার রয়েছে, যার কিডনির সমস্যা রয়েছে, হার্টের সমস্যা রয়েছে, তার যদি ওষুধটা বাদ পড়ে যায়, তাহলে বিপদ হয়ে যেতে পারে। তাহলে মূল ওষুধগুলো আমরা ইফতারের সময় নিয়ে আসার চেষ্টা করি। আর ডায়াবেটিসের জন্য আমরা যখন ওষুধ দেব, ইনসুলিন দেব যা-ই দেই না কেন, সেহরির ডোজকে রোগীর চাহিদা অনুযায়ী, পরিমাণ অনুযায়ী আমরা কমিয়ে দেব।
প্রশ্ন : হার্টের রোগীদের জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
উত্তর : যে গাইডলাইন রয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে কিডনি খারাপের সঙ্গে ডায়াবেটিস থাকলে রোজা রেখ না। কিডনি খারাপ হলে কতটুকু কিডনি খারাপ আমরা এটি দেখি। রোজার আগে আমি রোগীকে বলেছি, আপনি আগে থেকে কিছু রোজা রেখে নেন। দেখুন আপনার সমস্যা হচ্ছে কি না। যদি মনে করেন, আপনার সমস্যা হচ্ছে, আপনি রাখবেন না। আল্লাহ আমাকে জীবনকে শেষ করে রোজা রাখতে বলেননি। কারণ, উনি আমার থেকে ভালো জানেন, আমার শরীরের অবস্থা কেমন। যদি দেখেন আপনি পারছেন না, আপনি রাখবেন না।
উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে আমরা বলি এর জন্য ভালো অপশন হলো ড্যাশ ডায়েট। ড্যাশ ডায়েট হলো ডায়াটারি অ্যাপ্রোচ ফর সিস্টেমিক হাইপারটেনশন। এই ড্যাশ ডায়েটে যেগুলো হবে, আমি যে খাবারগুলো খাব, এতে লবণ থাকবে না। দুই নম্বর হলো, পটাশিয়াম জাতীয় খাবার বেশি থাকবে। এর মানে, আমি ফল অনেক বেশি খাব। রমজানে খাবার টেবিলে ফল থাকতেই হবে। সবুজ শাক- সবজি আমি যতটুকু পারি খাব। আমি এমন কিছু খাব না যেটি আমার জন্য কষ্টের কারণ।
রোজায় যারা তারাবি নামাজ পড়ে তাদের কিন্তু ব্যায়ামটা হয়ে যায়। যারা তারাবি নামাজ পড়তে পারে না, তাদের আমরা বলি আপনি ইফতারের পর হাঁটতে চলে যান। তাই রমজান মাসে যে স্বাস্থ্যকর খাবার সেটিই আমরা খেতে বলছি।
প্রশ্ন : শিশুরা সুস্থভাবে রোজা রাখতে কী করবে?
উত্তর : ওদের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হলো, পানির ধারণ কম থাকে। খুব ছোট যারা তাদের তো আল্লাহ রোজা রাখতে বলেননি। আমরা বলি প্রেকটিস করার জন্য একটি বা দুটি রাখ। যারা বড় হয়ে গেছেন তারা তো পারবেন।