জরায়ুমুখের ক্যানসার চিকিৎসায় করণীয়
বর্তমানে দেশে জরায়ুমুখের ক্যানসারকে এক নম্বর ক্যানসার বলা হয়। বিভিন্ন কারণে এই ক্যানসার হয়। প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা নিলে রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভব। তবে দেরিতে চিকিৎসা মৃত্যুঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়। আজ ৫ সেপ্টেম্বর এনটিভির ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২১৪২তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের প্রসূতি ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগে কর্মরত গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. নাইমা শারমিন হক।
প্রশ্ন : জরায়ুমুখের ক্যানসার নারীদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এক নম্বর ক্যানসার। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নারী এ রোগে আক্রান্ত হন.....
উত্তর : মৃত্যুর হারের দিক থেকে দ্বিতীয় ক্যানসার এটি।
প্রশ্ন : এই ক্যানসার অত্যন্ত ভয়াবহ। অনেক নারী এতে আক্রান্ত.....
উত্তর : প্রতি বছর প্রায় ১২ হাজার নারী আক্রান্ত হন।
প্রশ্ন : এর কারণ কী? এতে ঝুঁকিপ্রবণ কারা?
উত্তর : যদি গবেষণার দিক থেকে চিন্তা করেন, এইচপিভি ভাইরাস সংক্রমণের কারণে জরায়ু মুখের ক্যানসার হয়।আর ব্যক্তিগত কারণ যদি ধরেন, সে ক্ষেত্রে দেখা যায় যে একজন নারীর বয়স, আমরা বলি ৩৫-৫৫ এই বয়সগুলো একজন নারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যদি তার খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে থাকে, আমাদের দেশে নয় বছর, ১০ বছর বয়সে কোথাও কোথাও বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়, এই বাচ্চাটা খুব অল্প বয়সে সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করেছে, এর ফলে তার সাংসারিক জীবনটা বেশি হচ্ছে। বারবার সন্তান জন্ম দিচ্ছে। এ ছাড়া কারো যদি অনেক যৌনসঙ্গী থাকে, তবে সমস্যা হতে পারে। তবে এইচপিভি সংক্রমণ মূল কারণ জরায়ুমুখের ক্যানসারের।urgentPhoto
প্রশ্ন : ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাও কী কারণ হিসেবে কাজ করে?
উত্তর : হ্যাঁ ভূমিকা রাখে। নিম্নমধ্যবিত্ত লোকদের এই কারণে সমস্যা হতে পারে।
প্রশ্ন : একজন নারী যদি এই ক্যানসারে আক্রান্ত হোন, প্রাথমিকভাবে কী সমস্যা হতে পারে? কী সমস্যা দেখলে তার ভাবা উচিত আমার চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে?
উত্তর : এটা হতে পারে অনিয়মিত মাসিক হওয়া। এ ছাড়া দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব হচ্ছে বা দুর্গন্ধ যুক্ত পানি নিঃসরণ হচ্ছে। অথবা কেউ কেউ এসে বলে আমি ভালো থাকি, তবে যখনই স্বামীর সাথে থাকি আমার রক্তপাত হয়। এটা আসলে প্রধান একটা লক্ষণ। কেউ যদি অভিযোগ করে স্বামীর সাথে থাকলে তার রক্তপাত হয় এবং দুর্গন্ধযুক্ত সাদাস্রাব বা দুর্গন্ধযুক্ত পানি বের হলে- এটাকে এড়ানো ঠিক নয়। দেখা যায় এই ব্যক্তিটিরই স্ক্রিনিং করলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জরায়ুমুখের ক্যানসার বেরিয়ে আসে।
প্রশ্ন : আমরা জানি জরায়ুমুখের ক্যানসার অনেকটাই প্রতিরোধযোগ্য। প্রতিরোধের জন্য কী কী করা উচিত? এবং স্ক্রিনিং দ্বিতীয়ভাগের প্রতিরোধের জন্য কী কী ভূমিকা রাখে?
উত্তর : প্রতিরোধ আমরা দুই ভাবে করি। একটা প্রাইমারি প্রিভেনশন (প্রাথমিক প্রতিরোধ), যেটা ভ্যাকসিনেশনের মাধ্যমে করি। আর সেকেন্ডারি প্রিভেনশন (দ্বিতীয় প্রতিরোধ) হলো স্ক্রিনিং। যে ঝুঁকির কারণগুলো বলেছেন, সেগুলো এড়িয়ে যেতে হবে।
প্রাথমিক প্রিভেনশনের জন্য ভ্যাকসিনেশন। আমাদের দেশে এখন দুটো ভ্যাকসিনেশন রয়েছে। সারভারিক্স ভ্যাকসিনেশন, এটা আমাদের দেশে খুব সহজলভ্য। সারভারিক্সটা আমরা দিতে বলি ৯ থেকে ১৪ বছরের মেয়েদের। দুটো ডোজ দেওয়া হয়, পয়েন্ট পাঁচ এমএল। এটা আজকে দিলে প্রথম ডোজ, ছয় মাস পরে দ্বিতীয় ডোজ। আর ১৫ থেকে বাকি সময়টুকু ৪৫ থেকে ৫৫ বছর পর্যন্ত কাউকে দিলে তিনটা ডোজ দিতে হবে। আজকে প্রথম ডোজ দিলে, দ্বিতীয় ডোজ এক মাস পর, তৃতীয় ডোজ হবে আজকে থেকে ছয় মাস পর। এই ডোজ নিলেও তাঁকে স্ক্রিনিং এর মধ্যে থাকতে হবে। তাঁকে প্রতি বছর প্যাপসমেয়ার টেস্ট করতে হবে।
প্রশ্ন : স্ক্রিনিংয়ে আপনারা কী করে থাকেন?
উত্তর : স্ক্রিনিংয়ে সাধারণত প্যাপসমেয়ার বা জরায়ুমুখের রস পরীক্ষা করি। আর ভায়াটেস্ট করা হয়। সম্প্রতি এইচপিভিডিএনএ টেস্ট করা হয়।
প্রশ্ন : এ বিষয়গুলো কী, যদি একটু বুঝিয়ে বলেন...
উত্তর : প্যাপসমেয়ার হলো, জরায়ুমুখ থেকে এসেপটিক পদ্ধতিতে রসটা সংগ্রহ করা হয় এবং সেটা মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখা হয়। জরায়ু মুখের রসের মধ্যে যেই কোষগুলো রয়েছে এগুলো কী স্বাভাবিক, নাকি প্রি-ক্যানসারাস বা ক্যানসার সৃষ্টিকারী কোনো উপাদান আছে তাতে- এটা নির্ণয় করা হয়। আমাদের দেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে প্যাপসমেয়ার করা হয়। কিছু বেসরকারি সেক্টরেও করা হয়। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ে সহজলভ্য। আর ভায়াটেস্ট মোটামুটি সব মেডিকেল কলেজে আছে। গ্রামাঞ্চলে ভায়াটেস্ট বেশি করা হচ্ছে কারণ সেখানে প্যাপসমেয়ার বেশি সহজলভ্য নয়। ভায়া টেস্টে জরায়ুমুখে আমরা পাঁচ শতাংশ এসিটিক এসিড প্রয়োগ করি, এক মিনিট পর ওই অংশ যদি সাদা রঙের হয়ে যায়, যেটাকে আমরা বলি এসিটোহোয়াইট– এই রকম অংশ পেলে আমরা বলি ভায়া পজিটিভ। মানে হচ্ছে, তার সমস্যা থাকতে পারে, ইভ্যালুয়েশন (মূল্যায়ন) দরকার।
প্রশ্ন : সেখানে কী করে থাকেন?
উত্তর : সেখানে এইচপিভিডিএনএ টেস্ট করতে দিতে পারি, যদি রোগী বহন করতে পারে।
প্রশ্ন : আপনারা কী সেখান থেকে হিসটোপ্যাথোলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য নমুনা নেন?
উত্তর : যদি যেখানে এসিটিক এসিড দেওয়া হয়েছে সেই অংশটির রং পরিবর্তন হয় তখন আমরা রোগীকে কল্পোস্কোপ করতে দেই। প্রয়োজনে আমরা কল্পোস্কোপ থেকে, ওই বৃদ্ধি থেকে, কল্পোস্কোপ গাইডেড বায়োপসিও করতে পারি। বায়োপসি আমাদের শেষ ফলাফল দেবে যেকোনো ধরনের পরিবর্তন এখানে হয়েছে। সেটা কী স্বাভাবিক সংক্রমণ থেকে পরিবর্তন, নাকি প্রি-ক্যানসারাস পরিবর্তন। অথবা এটা একেবারেই ক্যানসার কোষে পরিবর্তন হয়েছে কি না।
প্রশ্ন : প্রি-ক্যানসারাস পরিবর্তন হলে ক্যানসার যাতে না হয় বা প্রতিরোধে কী করেন?
উত্তর : যদি আগে ধরা পড়ে, আমরা কিছু শব্দ ব্যবহার করি। যেমন: সিআইএন ওয়ান, টু, থি। সিআইএন ওয়ান থাকলে আমরা কেবল পর্যবেক্ষণে রাখতে পারি। ছয় মাস, একবছর পর আমরা রোগীকে ফলোআপে রাখতে পারি। আবার যদি সিআইএন টু, থ্রি হয়ে যায়। তাহলে জটিলতা বিবেচনা করে রোগীকে চিকিৎসার কথাই বলি। সার্জারির পরামর্শ দেই।
প্রশ্ন : যদি আগে ধরা না পড়ে বা কেউ গাফিলতি করে না আসে, সেই ক্ষেত্রে এর জটিলতা বা পরিণতি কী হতে পারে?
উত্তর : একটা প্রবাদ আছে, ক্যানসারের কোনো উত্তর নেই। রোগীর বেঁচে থাকার হার অনেক কম। যদি কারো প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ে, তাকে শুধু যে অবস্থায় ক্যানসার কোষটা আছে ওইটুকু অংশ যদি সরিয়ে দিতে পারি তিনি হয়তো ৫-১০ বছর ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারেন। কিন্তু যদি খুব জটিল অবস্থায় আসে, অবশ্যই সার্জিক্যাল চিকিৎসা দিতে হবে। পরবর্তীতে রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি সবই দিতে হবে। যত প্রাথমিক পর্যায়ে আসবে তার নিরাময়ের সম্ভবনা তত বেশি। যত দেরি করে আসবে মৃত্যু ঝুঁকি তত বাড়বে।