শিশুদের সময়ের রোগব্যাধি
কখনো গরম বা কখনো বৃষ্টি এমন আবহাওয়ার কারণে শিশুরা এ সময়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। এ সময়ের রোগ প্রতিরোধে বাবা-মাকে বাড়তি সচেতন হতে হবে। আজ ২২ আগস্ট এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১২৮তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রাসেল সিদ্দিকী। যিনি কর্মরত আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশুরোগ বিভাগে।
প্রশ্ন : আমরা জানি ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রোগব্যাধির প্রকোপও বাড়ে-কমে। এই সময় একদিকে গরম আবার বর্ষা। শিশুরা নানা রকম রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। কী কী রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে?
উত্তর : এই সময়ে সাধারণত শিশুরা শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, ঠান্ডা, সর্দি, কাশি এবং সেই সঙ্গে পানিবাহিত কিছু রোগ যেমন টাইফয়েড এসবে ভোগে। এ ছাড়া এই সময় ডেঙ্গু জ্বরেরও প্রাদুর্ভাব রয়েছে। এ ছাড়া ডায়রিয়া, আমাশয়- এসব পানিবাহিত সমস্যা হচ্ছে।
প্রশ্ন : এই সময় আরেকটি প্রচলিত রোগ হলো জ্বর। আপনি বলছিলেন সাধারণ জ্বর হতে পারে, টাইফয়েড বা ডেঙ্গু জ্বর হতে পারে। একটা শিশু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর বোঝার উপায় থাকে কি আসলে কোন জ্বর হয়েছে বা করণীয় কী?
উত্তর : আসলে সেই ক্ষেত্রে প্রথমে লক্ষ করতে হবে শিশুটির জ্বরের সঙ্গে সর্দি-কাশি রয়েছে কি না। যদি সর্দি-কাশি থাকে তাহলে একে আমরা সাধারণত সর্দিজ্বর বলি বা ভাইরাল ফিবার বলে ধরে নিতে পারি। তবে যদি জ্বরের সঙ্গে অন্য কোনো উপসর্গ না থাকে শুধু গা ব্যথা, মাথাব্যথা বা শরীর ব্যথা এ ধরনের উপসর্গ থাকে তাহলে এটা ভাইরাস জ্বরও হতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরও হতে পারে। আর জ্বরের সঙ্গে যদি আন্ত্রিক কোনো সমস্যা থাকে যেমন আমাশয় বা পাতলা পায়খানা এ ধরনের সমস্যা থাকলে সাধারণত টাইফয়েড হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
প্রশ্ন : যে ধরনের জ্বরই হোক প্রাথমিক অবস্থায় কী করণীয়? আমাদের দেশে শিশুর জ্বর বা কোনো রোগ হলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করে দেয়। আসলে কী করণীয়?
উত্তর : আসলে এ ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই ভালো। যদি সেটি সম্ভব না হয়, তবে প্রথম দুই-তিনদিন লক্ষ রাখতে হবে শিশুর জ্বরের মাত্রা কেমন এবং জ্বরের সঙ্গে কী ধরনের উপসর্গ রয়েছে। যদি জ্বরের সঙ্গে তেমন কোনো উপসর্গ না থাকে, শুধু জ্বর, সর্দিকাশি থাকে তাহলে দু-তিনদিন শুধু প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ এবং খুব বেশি প্রয়োজন হলে শিশুর নাক পরিষ্কার করে দেওয়ার জন্য সাধারণ স্যালাইন যথেষ্ট। সঙ্গে একটু অ্যান্টিহিসটামিন দেওয়া যেতে পারে।
প্রশ্ন : যদি প্যারাসিটামলে দু-তিনদিনে ভালো না হয়, তাহলে চিকিৎসকের কাছে নিলে আপনারা কী করেন?
উত্তর : আমরা সাধারণত রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করার চেষ্টা করি আসলে এটা কী ধরনের রোগ। যেহেতু দু-তিনদিন পার হয়ে গেছে একে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। সেই ক্ষেত্রে যদি টাইফয়েড জ্বরের ধারণা করি, তখন ব্লাড কালচার করব। এ ছাড়া একটি পূর্ণ ব্লাড কাউন্ট এবং পেরিফেরাল ব্লাড ফ্রেম অবশ্যই করব। যদি রক্তে অনুচক্রিকার পরিমাণ কমে গিয়ে থাকে, তাহলে আমরা ডেঙ্গু জ্বর ধরে নিতে পারি। যদি দেখা যায় রক্তে অনুচক্রিকার পরিমাণ স্বাভাবিক আছে এবং সঙ্গে অন্যান্য উপসর্গ রয়েছে, সে ক্ষেত্রে ধারণা করা যেতে পারে টাইফয়েড জ্বর হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ব্লাড কালচারের প্রতিবেদনের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। যদি রক্ত পরীক্ষার পর প্রতিবেদনে টাইফয়েডের জীবাণু পাওয়া যায়, সেখান থেকে আমরা নিশ্চিত হই টাইফয়েড কি না।
প্রশ্ন : কিন্তু টাইফয়েডের জন্য একটা শিশুকে কিছুদিন প্যারাসিটামিল খাইয়ে অপেক্ষা করালেন, এরপর পরীক্ষা করতে দিলেন। এতদিন অপেক্ষা করাবেন?
উত্তর : তবে এর মধ্যে যদি ধারণা করা হয় টাইফয়েড তখন অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করে দিতে হবে। এরপর কালচারের রিপোর্ট আসার পর এ ধরনের জীবাণুর ক্ষেত্রে যেই ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর সেটা শুরু করতে হবে। ওই প্রতিবেদনের সঙ্গে মিলিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক ঠিক করে নেব।
প্রশ্ন : এই সময় ডেঙ্গু জ্বরে বড়রা এবং শিশুরা উভয়ই আক্রান্ত হচ্ছে। ডেঙ্গু জ্বর এ সময়ে বাড়ছে কেন?
উত্তর : আসলে কোনো সময় অল্প বৃষ্টি বা বৃষ্টি না থাকা এসব কারণে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। জলাবদ্ধতার জন্য মশার যে বংশ বৃদ্ধি হচ্ছে সেই কারণেই সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরের প্রভাব বা প্রকোপ এই সময়ে বেড়ে যায়।
প্রশ্ন : ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেড়ে যাওয়া প্রতিরোধে করণীয় কী?
উত্তর : এটার প্রতিরোধের জন্য যেসব জলাবদ্ধতা দেখা দিতে পারে সেগুলো আসলে পরিষ্কার করে নেওয়াই ভালো। যেমন আপনার বাড়ির সামনে টবের মধ্যে পানি জমতে পারে। অথবা আপনার বাড়ির আশপাশে হয়তো একটু নিচু জায়গা আছে, ডোবার মতো আছে এগুলো জায়গায় সাধারণত মশা বংশ বিস্তার করে থাকে। এডিস মশা সাধারণত কামড় দিলে আসলে ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেই ক্ষেত্রে মশা কি দিনের বেলায় কামড় দিচ্ছে কি না এই ক্ষেত্রেও কিছুটা সচেতন হতে হবে।
প্রশ্ন : যদি ডেঙ্গু জ্বরে কেউ আক্রান্ত হয়ে যায় তাহলে তার চিকিৎসার ক্ষেত্রে কী করণীয়?
উত্তর : আসলে ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে লক্ষণ বুঝে চিকিৎসাই যথেষ্ট। আর যদি রক্তক্ষরণ হয়ে না থাকে, তাহলে স্বাভাবিক জ্বর বা ভাইরাস জ্বর যেভাবে আমরা চিকিৎসা করে থাকি সেভাবেই চিকিৎসা করতে হবে। যেমন শরীর ব্যথা বা জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল দেওয়া হয়। পানিজাতীয় খাবার খাবেন এবং অবশ্যই বিশ্রামে নিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও পরামর্শ নিতে হবে।
প্রশ্ন : শিশুদের জ্বরের বাইরে প্রচলিত যে রোগের কথা বলছিলেন, সেটা হলো পানিবাহিত। সেটা প্রতিরোধের জন্য কী পরামর্শ?
উত্তর : সেটা প্রতিরোধের জন্য বাবা-মাকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। এবং তার শিশু যেন বিশুদ্ধ পানি পান করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুকে শিক্ষা নিতে হবে যে তার কী ধরনের পানি পান করা উচিত।
প্রশ্ন : সাধারণত আমরা দেখি শিশুরা বাইরে গেলে বাইরের খাবার খেতে চায়। এ বিষয়ে সতর্কতা কতটা জরুরি?
উত্তর: আসলে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে ধরনের খাবারে সাধারণত রোগ সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে সে ধরনের খাবার পরিহার করে চলাটাই শ্রেয়।
প্রশ্ন : শিশুদের আরেকটি সমস্যার বিষয়ে আপনি বলছিলেন শ্বাসকষ্ট বা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা। একটি শিশু যদি শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়, তাহলে প্রাথমিকভাবে করণীয় কী? এবং কোন পরিস্থিতি দেখলে তাকে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে নেওয়া উচিত?
উত্তর : শিশুর শ্বাসকষ্ট সাধারণত দুই ধরনের হয়। একটি শ্বাসনালির ওপরের অংশের প্রদাহ এবং আরেকটি নিচের অংশের তথা ফুসফুসে সংক্রমণ, দুটো হতে পারে। যদি শিশুর ক্ষেত্রে শ্বাসনালির ওপরের অংশে প্রদাহ হয়ে থাকে, যেমন গলার পেছনের অংশে ফ্যারেনজাইটিস হতে পারে। টরসিলে সংক্রমণ হতে পারে। এই ক্ষেত্রে বাবা-মা খেয়াল করে দেখতে পারেন শিশুর খেতে অসুবিধা হচ্ছে কি না এবং খাবার গিলতে অসুবিধা হচ্ছে কি না। তখন বুঝতে হবে শিশুর গলায় প্রদাহ হয়েছে। আর যদি শিশু ঘন ঘন শ্বাস নেয় বা শ্বাস নেওয়ার সময় বা ছাড়ার সময় তাকে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করতে হচ্ছে এবং ঘন ঘন শ্বাস নেওয়ার পর যদি বুক ওঠানামা করে এ ক্ষেত্রে বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। এ সময় শিশুকে দ্রুতই চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।