পর্যাপ্ত দুধ খাওয়ালে স্থুলতা কমে মায়ের
শিশুর পুষ্টির পাশাপাশি মায়ের পুষ্টির বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।আর একজন নারীর পুষ্টির বিষয়টি আসলে শুরু হয় বয়সন্ধি থেকেই।একজন পুষ্টিপ্রাপ্ত মা একটি সুস্থ শিশু জন্ম দিতে পারবেন।আজ ১৮ আগস্ট এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১২৪তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক ডা. ফাতিমা পারভীন চৌধুরি।
প্রশ্ন : আমরা তো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জানি শিশুর পুষ্টি নিয়ে। সেটির গুরুত্ব অবশ্যই সবার কাছে অপরিসীম। সেই সাথে যে মায়ের পুষ্টিটাও দরকার, আর সেটি যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেটি এখনো সবাই জানি না। একজন মা তিনি গর্ভবতী হতে পারেন বা স্তনদানকারী হতে পারেন- সেই মায়ের পুষ্টি কতখানি জরুরি?urgentPhoto
উত্তর : মায়ের পুষ্টি বলতে যে কথাটা আমরা সাধারণত বোঝাতে চাই- সেটা হলো গর্ভাবস্থায় এবং যখন বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছেন। কিন্তু আমরা ভুলে যাই একটা মেয়ে মানেই হলো মা। তাই মায়ের পুষ্টি আর একজন মেয়ের পুষ্টি কেবল এপিঠ-ওপিঠ। আমরা যদি প্রথম থেকে একটা তরুণীকে বা একটা মেয়েকে তার উপযুক্ত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার না দিয়ে তাকে উপযুক্তভাবে তৈরি করতে না পারি সে নিশ্চই আমাদের সুস্থ বাচ্চা দিতে পারবে না। আর অনেক পুষ্টির উপাদান আছে যা শুধু গর্ভাবস্থায় দিয়েও ওই মেয়েটার পুষ্টিকে সঠিক জায়গায় নিতে পারব না। তাই পুষ্টি তার বয়োসন্ধিকালীনই শুরু করতে হবে। পরবর্তীকালে সে যখন গর্ভধারণ করল, গর্ভধারণ করার সাথে সাথে আমাদের মনে রাখতে হবে, এখন দুজনকে খাওয়াচ্ছি। মাকে কোনো পুষ্টি দিচ্ছি মানে ওই পুষ্টিটা শিশুর জন্যও দিচ্ছি। এজন্য একটি প্রচলিত গ্রাম্য কথা রয়েছে, সবসময় একমুঠো খাবার বেশি খেতে হবে। চাল হোক, ডাল হোক, মাছ হোক, মাংস হোক- একমুঠো খাবার বেশি বেশি করেই ওই মাকে খাওয়াতে হবে, তার গর্ভের শিশুটির পুষ্টির কথা চিন্তা করে। কারণ যদি ওই মা তার পর্যাপ্ত পুষ্টি না পান শিশুটিও কম ওজনের হবে। কম ওজনের শিশু হলে ওই বাচ্চাকে নিয়ে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হবে, অনেক ভুগতে হবে। তাই গর্ভাবস্থায় পুরোপুরি যেটাকে বলে ব্যালেন্স ডায়েট , সুষম খাবার ওই খাবার দিতে হবে এবং পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে।
প্রশ্ন : সুষম খাবার বলতে আপনি কী বোঝাবেন?
উত্তর : প্রোটিন বলতে আমরা কোন জিনিসগুলো বোঝাই- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ এ ধরনের জিনিসগুলো বোঝাই। আমরা কার্বোহাইড্রেট বলতে কী বুঝি- ভাত, আলু, আটা, ময়দা ইত্যাদি। আবার শাকসবজির মধ্যে সব ধরনের ভিটামিন , মিনারেল এগুলো আসছে। চর্বি বলতে আমরা তেল বোঝাই বা অন্য যেই ধরনের চর্বি আসে সেগুলো বোঝাই। এগুলো সব যেন পর্যাপ্ত পরিমাণে মা খান তাকেই আমরা সুষম খাবার বুঝি। সুষম খাবার খেতে হলে পরিমাণও তার ঠিক থাকতে হবে। আবার সব উপাদানও থাকতে হবে।
প্রশ্ন : আমরা দেখি যখন একজন মা গর্ভধারণ করেন তাঁর খাবারে ভয়াবহ রকম অরুচি কাজ করে। সেই ক্ষেত্রে ওই সময়ের পুষ্টি যাতে ঠিক করা যায় সেই ক্ষেত্রে কী করণীয়?
উত্তর : এখানে আমার একটি ব্যক্তিগত মতামত আছে। অরুচির কথা আসলে এখানে ঠিক না। একটু পরিবর্তিত রুচি হয়। কেউ হয়তো দেখা যাচ্ছে রুটিন খাবার যেগুলো খেত ওইভাবে খেতে পারছে না। সে একটুখানি পরিবর্তন করে দিলে খেতে পারছে। পরিবারের লোকদের ওই বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে, সে কোন জিনিসটি খেতে পারে। যদি ফলের রস বেশি খেতে পারে, তাহলে ফলের রস পরিমাণে বেশি খাক। যদি সে সলিড খাবারের চেয়ে লিকুইড খাবার বেশি পছন্দ করে সেটা বেশি খাক। মাকে একটু কষ্ট করে খেতে হবে। পাশপাশি খাওয়াটাকে একটু পরিবর্তন করলেই সে খেতে পারবে। আর যদি তেমন কোনো সমস্যা হয় তবে তো চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু সাধারণভাবে যেটা দেখা যায়- এটাকে আমি অন্তত অরুচি বলব না। আমি বলব পরিবর্তিত রুচি। পরিবর্তন করে দিলেই হবে।
আরেকটি জিনিস খেয়াল রাখতে হবে যখন থেকে গর্ভে সন্তান এসেছে- এটি ধরা পড়ল; ওই মেয়েটাকে পরামর্শ দিতে হবে যে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোতে কী উপাকার। কতটুকু পরিমাণ খাওয়াতে হবে। আস্তে আস্তে যখন বাচ্চাটা ভূমিষ্ঠ হলো, ধরে নিলাম, সে সুস্থ সবল বেশি ওজনের একটা শিশু জন্ম দিল তখনো কিন্তু মায়ের পুষ্টির চিন্তা আমরা বাদ দিতে পারব না। ওই সময় তাকে আরো খেতে হবে। যেমন একমুঠো বলেছিলাম ওই সময় আরো বেশি খেতে হবে।
আর এখনকার আধুনিক মায়েরা একটা জিনিস ভাবেন- ওই সময় বেশি খেলে মোটা হয়ে যাবেন, শরীর নষ্ট হয়ে যাবে। হ্যাঁ, কিছুটা যে অস্বীকার করা যাবে তা নয়। তবে যদি শিশুটি সঠিকভাবে বুকের দুধ খায়- মা আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। কারণ শিশুটি মায়ের সব পুষ্টির অনেকটুকুই নিয়ে নিচ্ছে। তাই যদি মা সঠিকভাবে তার বাচ্চাকে দুধ দেন তবে ওজন এমনিতেই কমে আসবে। অন্তত দুই বছর পর্যন্ত মা তার বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াবেন এবং এই সম্পূর্ণ সময়টায় তাঁর খাওয়াটা পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হতে হবে।
এ ছাড়া উপযুক্তভাবে, ঠাণ্ডা মাথায় বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে হবে। দুধ খাওয়ানোর সময় একটা বিষয় আছে চোখের যোগাযোগ, ত্বকের স্পর্শ এগুলো করবে। এতে মা আর শিশুর যে মধুর সম্পর্ক হবে এতে সমাজের অনেক অবক্ষয় থেকেও আমরা মুক্তি পাব। মা যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টি পান, পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার বাচ্চাকে দেন অনেক অনেক রোগ থেকে সেই মা মুক্ত হবেন। মায়ের রোগ প্রতিরোধও অনেক বেড়ে যায় ওই সময়ে যদি তিনি বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ান এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার খান।
এই ক্ষেত্রে আমি বিশেষভাবে বলব- পরিবারের অন্য সদস্যরা সবাই যদি ওই বিষয়টা বোঝেন ওই মেয়েটা আমার জন্য কতটা কাজ করছেন, আমার ভবিষৎ তৈরি করে দিচ্ছেন- সেভাবে যদি তাঁর খাবারটা লক্ষ করেন তাহলে আমাদের সমাজের অনেক সমস্যা দূর হবে।
শারীরিক পুষ্টি কাজে লাগার একটি পূর্ব শর্ত হলো তার মানসিক স্বাস্থ্য। একটি জিনিস মজা করে, রুচি সম্পন্ন ভাবে খেলে যতটুকু কাজে আসবে, যদি কোনো রকম মুখ বন্ধ করে গেলানো হয় ততটা কাজে আসবে না।
প্রশ্ন : এই জিনিসটি আসলে সবাই বোঝে না। যারা মা হয়েছে তাদের আশপাশের লোকদের ভূমিকা এখানে অনেক.....
উত্তর : হ্যাঁ। আবার বাচ্চাকেও দেখবেন অনেকে ধরে জোর করে খাবার গিলিয়ে দেয়। আপনি হয়তো খাওয়াতে পারবেন, তবে সেটা হয়তো তার ভেতরে থেকে যাবে প্রকৃত কাজে আসবে না।
প্রশ্ন : একজন মা যখন বাচ্চার যত্ন নিচ্ছেন ওই সময় তাঁর কী কোনো জটিলতা হতে পারে কি না? আর সেটি বোঝার উপায় কী?
উত্তর : জটিলতা বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন? মা দুধ দিতে পারছে না?
প্রশ্ন : হ্যাঁ এটাই বোঝাতে চাইছি ....
উত্তর : সে রকম হতে পারে। যেমন ধরেন একটি বাচ্চার মা মারা গেলেন বা যেকোনো কারণে, দুরারোগ্য কোনো ব্যাধির কারণে হোক মা বাচ্চাকে দুধ দিতে পারছেন না। এটার জন্য পরিষ্কার দিক নির্দেশনা আছে- যাকে বলি ওয়েট নার্সিং। পাশে যদি কোনো মা থাকেন তিনি খাওয়াতে পারবেন। একজন মা তিনটা শিশুকে একসঙ্গে দুধ দিতে পারেন। পাশের কোনো নারী যে স্তন পান করান তাঁর শিশুর সঙ্গে তিনি সহজেই শিশুটিকে দুধ দিতে পারবেন। তাঁর বড় একটা প্রমাণ তো আমাদের মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)। তিনি তো তার দুধ মায়ের কাছেই বড় হয়েছেন। আর এই দুধ মায়ের সম্মান ইসলাম ধর্মে অনেক উঁচুতে।
প্রশ্ন : তারপরও আপনারা কৌটার দুধ দিতে কখনোই পরামর্শ দেবেন না ...
উত্তর : কখনোই আমরা সেটা করব না। একটি শিশুর জন্য তার মায়ের দুধটাই একমাত্র খাবার। ডব্লিউএইচও বলেছে- আমাদের কৌটার দুধগুলো ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস মুক্ত নয়। আর এই ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসের রোগ প্রতিরোধের জন্য যা দরকার সেটা মায়ের দুধে আছে। সেই মায়ের দুধ পুরোপুরিভাবে শিশু পাবে যদি মায়ের পুষ্টিটা ঠিক মতো থাকে।