স্তন ক্যানসার, নিয়মিত নিজেই পরীক্ষা করুন
বিভিন্ন গবষেণায় বলা হয়,দেশের প্রায় ২৫ ভাগ নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত। তবে প্রাথমিক ভাবে ক্যানসার নির্ণয় করতে পারলে রোগটি সম্পূর্ণভাবে নিরাময় করা সম্ভব। আজ ২৮ জুন এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৮০তম পর্বে এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এম নিজামুল হক।
প্রশ্ন : অন্যান্য ক্যানসারের তুলনায় বাংলাদেশে নারীর স্তন ক্যানসার হওয়ার হার কেমন?
উত্তর : স্তন ক্যানসারের ওপর আমাদের জাতীয়ভাবে কোনো সমীক্ষা নেই। তবে আমাদের ক্যানসার হাসপাতালে প্রতি বছর আমরা সমীক্ষা চালাই। তাতে দেখা যায় শতকরা ২৫ ভাগ নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত।
প্রশ্ন : অন্যান্য ক্যানসারের তুলনায় এর হারটা কেমন?
উত্তর : নারীর ক্ষেত্রে এক নম্বর। অন্যান্য ক্যানসারের তুলনায় বিভিন্ন জায়গা অনুসারে কখনো প্রথম, কখনো দ্বিতীয়।
প্রশ্ন : একজন নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন কেন? এর ঝুঁকির কোনো কারণ আছে কি না? কোন বয়সের নারী এ ব্যাপারে ঝুঁকিপূর্ণ?
উত্তর : যেকোনো ক্যানসারেরই মূল কোনো কারণ বের করা সম্ভব হয়নি। এই ক্যানসারে সাধারণত চল্লিশোর্ধ্ব নারী আক্রান্ত হয়ে থাকেন। আর নারী হওয়ার কারণে সে নিজেই একটি ঝুঁকির কারণ। তার যদি পারিবারিক ইতিহাস থাকে, দেখা গেল তার মা, খাল বা ফুপুর আছে, তখন এই সমস্যা হতে পারে।
এ ছাড়া যদি দেরীতে সন্তান নেয় এই সমস্যা হতে পারে। অল্প বয়সে ঋতুস্রাব হওয়া বা দেরিতে ঋতুস্রাব হওয়া। জন্ম নিয়ন্ত্রণ ওষুধগুলোও একটা কারণ। আর জিনগত কিছু কারণ আছে। urgentPhoto
প্রশ্ন : সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ খাওয়ানোর সাথে কী স্তন ক্যানসার বাড়া বা কমার কোনো বিষয় আছে?
উত্তর : তেমন কোনো প্রমাণ এ বিষয়ে পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ খাওয়ালে ক্যানসারের লক্ষণ কমে।
প্রশ্ন : একজন নারী যখন স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন তখন তিনি কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন?
উত্তর : এটা নির্ভর করে কত দিন পর সে চিকিৎসকের কাছে আসছে তার ওপর। প্রাথমিক অবস্থায় দেখা যায় স্তনে অথবা বাহুর নিচে একটা চাকার মতো দেখা যেতে পারে। যেটা সাধারণত ব্যথা মুক্ত থাকে। এর ফলে আস্তে আস্তে স্তনের বোটা থেকে এক ধরনের নিঃস্মরণ (ডিসচার্জ) হতে পারে, রক্ত বা পুঁজ আসতে পারে। আর খুব বেশি দেরিতে হলে তার ব্যথা হতে পারে। চামড়ার রং পরিবর্তন হতে পারে। বোঁটা ডেবে যেতে পারে। চামড়া কমলা লেবুর মতো হতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে পানিও ঝড়তে পারে, দেরিতে যদি আসে। আর যদি বেশি দেরিতে আসে অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে গেলে তখন কাশির সাথে রক্ত আসতে পারে। যেমন ফুসফুসে যদি ছড়িয়ে যায়। হাড়ে গেলে সে ক্ষেত্রে ব্যথা হতে পারে।
প্রশ্ন : একজন নারী যখন এই সমস্যা নিয়ে আসেন তখন রোগ কীভাবে নির্ণয় করেন?
উত্তর : একজন রোগী যখন চিকিৎসকের কাছে আসে তখন আমরা প্রথম তার রোগের ইতিহাস নেই। চাকাটা কত দিনের, আস্তে আস্তে এটা বাড়ে কি না। তার পরিবারের কারো এই রোগ আছে কি না। তারপর কিছু শারীরিক পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয়। স্তনের ক্ষেত্রে আলট্রাসোনোগ্রাম করা যেতে পারে। এর পাশাপাশি বয়স অনুযায়ী এমআরআই করা যেতে পারে। মেমোগ্রাফি করা হয়। আর চাকা থাকলে এফএনএসি করা হয়, চাকা থেকে রস নিয়ে পরীক্ষা করে সাধারণত রোগ নির্ণয় করা হয়।
প্রশ্ন : চিকিৎসার জন্য কী পদ্ধতি আছে? স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা নিরাময় হয় কি না, কোন পর্যায়ে নিরাময় হয়?
উত্তর : এটি নির্ভর করে রোগী কোন ধাপে চিকিৎসকের কাছে আসছে এর ওপর। শূন্য পর্যায়ে ১০০ ভাগ ভালো হওয়ার সম্ভবনা থাকে। পর্যায় এক হলে কমে যাবে, ৮০ থেকে ৯০ ভাগ সম্ভাবনা থাকে ভালো হওয়ার। এখন যদি পর্যায় দুই হয় এই সম্ভাবনা আরো কমবে- ৬০ থেকে ৭০ ভাগ। পর্যায় তিন হলে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশে নেমে আসে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা। আর পর্যায় চার হলে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা ১০ শতাংশের কম হয়। এর মানে যত তাড়াতাড়ি রোগটি ধরা পড়বে তত তার ভালো হওয়ার সম্ভবনা বাড়বে।
প্রশ্ন : চিকিৎসা কীভাবে করেন?
উত্তর : চিকিৎসা নির্ভর করে রোগী কোন পর্যায়ে এসেছে তার ওপর। সাধারণত যদি চাকা থাকে, চাকা যদি অস্ত্রোপচার করার প্রয়োজন হয়, সে সময় অনেক ক্ষেত্রে চাকাটাই ফেলে দেওয়া হয়। চাকা ফেলে দিয়ে যাকে আমরা বলি লাম্পেকটমি অথবা ওয়াইড লোকাল এক্সিশন। এটাকে বড় মার্জিন করে স্তনকে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর সম্পূর্ণ স্তনে রেডিয়েশন থেরাপি দেওয়া হয়।
পরবর্তী কালে আমরা সাধারণত স্তনের কিছু পরীক্ষা করে থাকি। যাকে বলা হয় রিসেপটর স্ট্যাটাস, ইআরপি আর কেমন এসব দেখা হয়। ইআরপিআর ইতিবাচক থাকলে হরমোন চিকিৎসা দেই।
সাধারণত পর্যায় এক থেকে দুই পর্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে প্রথমে সার্জারি করতে হয়। এরপর কেমোথেরাপি। কেমোথেরাপির পর কোনো ক্ষেত্রে হরমোন থেরাপি দেওয়া হয়।
প্রশ্ন : স্তন ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য করণীয় কী?
উত্তর : রোগ চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম ব্যবস্থা। প্রতিরোধের জন্য সাধারণত চর্বিযুক্ত খাবার কম খেতে হবে। শাক সবজি ফল মূল বেশি খেতে হবে। ওজন কমাতে হবে। পরিমিত ব্যায়াম করতে হবে। বাচ্চাকে স্তন পানের অভ্যাস করাতে হবে। নিয়মিত নিজের স্তন পরীক্ষা করতে হবে। যেন কোনো সমস্যা মনে হলে চিকিৎসকের কাছে যেতে পারে।
প্রশ্ন : স্তনের নিজস্ব পরীক্ষার জন্য কোনো গাইডলাইন আছে কি?
উত্তর : গাইডলাইন আছে। ইন্টারনেটে এর নিয়মাবলি দেওয়া আছে। ক্যানসার হাসপাতালেও এর লিফলেট বিলি করে থাকি। সাধারণত একজন নারীর মাসিক হওয়ার পর থেকে, মাসিক হওয়ার দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পরবর্তী মাসিকের আগ পর্যন্ত যেকোনো সময় সে পরীক্ষা করতে পারে। একজন নারী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজে নিজে স্তন পরীক্ষা করতে পারে।
প্রশ্ন : কোনো নির্দিষ্ট সময়ে কি করতে হয়?
উত্তর : সাধারণত মাসিকের সাত দিন আগে অথবা মাসিকের দুই সপ্তাহ পরে করতে হয়।
প্রশ্ন : সে ক্ষেত্রে তার কী ধরনের পরিবর্তন দেখলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে আসা উচিত?
উত্তর : যদি স্তনের চামড়া কোনো কারণে পরিবর্তন হয়ে যায়। আকাবাঁকা হয়ে যাচ্ছে। বা কমলা লেবুর মতো হয়ে যাচ্চে। অথবা চাকা রয়েছে, আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে অথবা বোঁটায় চাপ দেওয়ার পর রক্ত বের হয়ে আসছে। অথবা বোগলের নিচে কোনো চাকা পাওয়া যাচ্ছে।
প্রশ্ন : এই ক্ষেত্রে অনেকে তো আতঙ্কিত হয়ে যেতে পারে আমার স্তনে ক্যানসার হয়েছে, ক্যানসার ছাড়াও কী কী সমস্যা এই বিষয়গুলোতে হয়?
উত্তর : সাধারণত স্তনের সংক্রমণের জন্য হতে পারে। স্তনে অনেক সময় বিনাইন টিউমার হয়। এর জন্যও হতে পারে। যেটা ক্ষতিকর নয়। ফাইব্রোয়েডিনোমা হলেও হতে পারে। তাই চাকা দেখলেই ভয়ের কিছু নেই। চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করিয়ে চিকিৎসা নেবেন।