আসছে কৃত্রিম কিডনি
কিডনি অকার্যকর হলে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডায়ালাইসিস ও প্রতিস্থাপনই ভরসা। তবে বিশ্বজুড়ে কৃত্রিম কিডনি তৈরির ওপর জোরেশোরে গবেষণা চলছে। সম্প্রতি শূকরের ওপর করা একটি গবেষণায় কিছুটা সফলতাও পাওয়া গেছে।
কৃত্রিম কিডনি কী, গবেষণার অগ্রগতি, বাংলাদেশে এর প্রেক্ষাপট ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেছেন ডা. এম এ সামাদ। বর্তমানে তিনি আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজে কিডনি বিভাগে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৬৪৩তম পর্বে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়।
প্রশ্ন : কৃত্রিম কিডনি কী?
উত্তর : আমি একটি খবরে দেখেছিলাম কৃত্রিম কিডনি দ্রুতই আসছে। ২০১৯ সালের শেষের দিকে এটি বাজারে পাওয়া যাবে। এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর যখন রোগীরা শুনেছে, তারা ছুটে এসেছে। রোগী প্রতিদিনই আসছে। জিজ্ঞেস করছে, ‘স্যার এটি কোথায় পাওয়া যাবে, কখন পাওয়া যাবে।’ সে জন্য আমি মনে করি আপনার এ প্রসঙ্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যখন কিডনি বিকল হয়ে যায়। তখন আমাদের শরীরে অনেক বিষাক্ত পদার্থ জমে যায়। আমাদের শরীরের কাজ হলো শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দিয়ে প্রস্রাবের মাধ্যমে বিষমুক্ত রাখা। সেই সঙ্গে কিডনি অতিরিক্ত পানি শরীর থেকে বের করে দেয়। এ ছাড়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে।
কিডনি এমনই হওয়া উচিত যেটি সব কাজ করবে। কিডনির বিকল্প হিসবে কাজ করবে। প্রথম এর গবেষণা শুরু হয় অনেকদিন আগে। বিশাল একটি ঘূর্ণায়মান ড্রামের উপরে টিউব দেয়, সেখানে ছিদ্র থাকে; রক্ত থেকে যেন বিষাক্ত পদার্থগুলো বেরিয়ে আসতে পারে, পানি থেকে যেনো প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ঢুকতে পারে। সেই ড্রামটি বড় একটি বাথটাবে স্যালাইনের মধ্য দিয়ে ঘুরানো হয়। টিউব থেকে দূষিত পদার্থগুলো টাবের পানিতে চলে আসে। পানি থেকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস রক্তে ঢুকে। এটি করে কল্প নামের একজন বিজ্ঞানী অনেক একিউট রেনাল ফেইলিউরের রোগী বাঁচিয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে যখন কোরিয়ার যুদ্ধ হয়, তিনি নেদারল্যান্ডসে অনেক একিউট রেনাল ফেইলিউরের রোগী বাঁচিয়েছিলেন। এরপর একে রূপান্তর করতে করতে আজকের মেশিন চলে এসেছে। আমাদের রোগীরা কিন্তু এটি জানতে চায় না। তারা ভাবে কৃত্রিম কিডনি এমন একটি বিষয় যেটি সম্পূর্ণ কিডনির কাজ করবে। তবে মেশিন তো কিডনির মতো নয়, এর ওজন ৩০০ পাউন্ড। এই মেশিন সঙ্গে নিয়ে ঘোরা যায় না। মেশিনের কাছে আমাদের যেতে হয়। বিজ্ঞানীরাও এখন এমন এক কিডনি আবিষ্কারের কথা ভাবছেন যেটি আসল কিডনির মতো কাজ করবে। এর সঙ্গে এ-ও ভাবছেন যে এমন মেশিন তৈরি করা যায় কি না, যেটি আমরা কোমরের বেল্টে বেঁধে ঘুরব। তো সেগুলো নিয়ে অনেকদিন ধরে গবেষণা চলছে। কিছু কিছু বিজ্ঞানী এ বিষয়ে কাজ করে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের একজন বিজ্ঞানী হলেন শুভ রায়। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামে, ঢাকায় জন্ম নিয়েছেন, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন কাজ করছেন। আরেকজন হলেন, ফিসেল। তিনি লস এনজেলেস-এ ভেন্ডারবিল বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছেন, আরেকজন হলেন গার্নার। এ রকম অনেকেই কাজ করছেন। কাজ করে তাঁরা কিছু দূর এগিয়েছেন।
যে প্রতিবেদন এসেছিল, সেটি এসেছিল শুভ রায়ের পরীক্ষা থেকে। তিনি চিন্তা করেছেন এত বড় কিডনি ছোট করতে করতে পেটে লাগিয়ে দেওয়া যায় কি না। কিন্তু এর আগেও কতগুলো ধাপ রয়েছে।
আমাদের চার ঘণ্টা করে ডায়ালাইসিস দিতে হয়, কিছু বড় মলিকিউল বের করা যায় না। ডায়ালাইজারকে রূপান্তর করে হাই ফ্লাক্স, মিডেল ফ্লাক্স করে দেওয়া হয়েছে। এগুলো যারা বেশিদিন ব্যবহার করে তারা তুলনামূলকভাবে বাঁচে। তবে এগুলোর দাম বেশি। যারা ডায়ালাইসিস করে তারা হয়তো বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যেতে চায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতে চায়। তারা কীভাবে যেতে পারে? বিজ্ঞানীরা ছোট ডায়ালাইজার তৈরি করছে। এটি বহনযোগ্য। ডায়ালাইসিসের সময় চার ঘণ্টায় ১২০ লিটার পানি লাগে। সেগুলো তাঁরা কমিয়ে একটি পাত্র নিয়ে এসেছেন। তাদের বোঝা অনেক কমে গেছে। তবে এটি পশ্চিমা বিশ্বে পাওয়া যায়। তবে তাঁরা ভাবছেন, এ মেশিনকে আরো ছোট করা যায় কি না। আরো ছোট ছোট করে শেষে যেটি বের করেছে এটি ১০ পাউন্ড ওজনের। ১০ পাউন্ড হলে তো কোমরে বেঁধেই নিই। বলা যেতে পারে এটি কৃত্রিম। এগুলো নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। কয়েক জায়গায় পরীক্ষা করে দেখা গেছে এগুলো ভালো কাজ করে। বিজ্ঞানী ফিসেল একে দুই পাউন্ডে নিয়ে এসেছেন। এমনভাবে সেট করে দেওয়া হয়, ব্যক্তি বেল্ট পরে, পোশাক পরে, সবই করতে পারে। তবে একে যখন পরীক্ষা করা হয়েছে, এই যে ডায়ালাইসিস ফ্লুইডগুলো যেটি ১২০ লিটার লাগে, একে মাত্র ৪০০ এমএল-এ নিয়ে আসেন। একে তো সব রক্তকে পরিশোধিত করতে হচ্ছে। পানিকে পুনরায় ব্যবহার করবে তারা। এই জন্য বিশুদ্ধিকরণ করতে হয়। বিশুদ্ধ করার জন্য কতগুলো মডেল বসানো হয়েছে ভেতরে। এখন ওই যে ডিভাইসগুলো রয়েছে সেগুলো বিষাক্ত পদার্থ টেনে নেয়। সেগুলো প্রতিস্থাপন করতে হয়। প্রতিস্থাপন করে রোগী ভালো থাকে। আট থেকে সাত ঘণ্টা পর এটি করতে হয়। এটি করতে গিয়ে কিছু কিছু জটিলতা দেখা দেয়। বিজ্ঞানীরা চিন্তা করছেন আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে এ জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পারবে। কাটিয়ে উঠতে পারলে ঠিকই একটি দুই পাউন্ডের মেশিন নিয়ে সব করতে পারবে। এর জন্য আরো দুই থেকে তিন বছর অথবা পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে। এটি তাঁদের ভবিষ্যৎ বাণী।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে এর পরিস্থিতি কী?
উত্তর : এখনও বাংলাদেশে এটি আসেনি। এর গবেষণা এখনো যুক্তরাষ্ট্রে হচ্ছে। ইটালি, যুক্তরাজ্যে গবেষণা হচ্ছে। তারা যৌথভাবে একটি দলগতভাবে গবেষণা করছে। আশা করা যাচ্ছে, আগামীতে এটি সফল হবে। আমাদের বিজ্ঞানী শুভ রায়, এর একটি অংশের দলপ্রধান।
কৃত্রিম কিডনির দুটো অংশ থাকবে। একটি অংশ দেহের বিষাক্ত পদার্থ ছেঁকে বের করে দেভে। আমাদের রক্তে যে প্রয়োজনীয় উপাদান রয়েছে, যেমন গ্লুকোজ একটি উপাদান, প্রোটিন একটি উপাদান, বিভিন্ন ধরনের হরমোন, এনজাইমকে ছেঁকে রেখে দেবে। কিন্তু ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন, ইনডোল জাতীয় বিষাক্ত উপাদান বের করে দেবে।
প্রশ্ন : শুভ রায়ের গবেষণার প্রক্রিয়াটির বাকি অংশটা কী?
উত্তর : এর দুটো অংশ। একটি অংশ ছেঁকে দেহের প্রয়োজনীয় পদার্থ রেখে দিচ্ছে, অপ্রয়োজনীয়গুলো বের করে দিচ্ছে।
আমাদের স্বাভাবিক কিডনি প্রতিদিন ১৮০ লিটার প্রস্রাব তৈরি করে। কিডনি সেগুলোকে ঘন করে মাত্র এক লিটারে আনে। যে পানি চলে যাচ্ছে, সেগুলো আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী দেহ আবার নিয়ে নেয়। সেই সঙ্গে পানির মধ্যে আরো যেসব উপাদান থাকে, যেমন সোডিয়াম, পটাশিয়াম ছাঁকনি দিয়ে চলে আসে। এগুলোকে এই টিউব পুনরায় নিয়ে যায়। কিন্তু ছেঁকে বের করে দিলে পুনরায় যদি না আনে তাহলে তো জিনিসটা ধ্বংস হয়ে যাবে। এগুলো আবার যেন নিয়ে আসতে পারে এ জন্য কৃত্রিম টিউবওয়েল তৈরি করা হচ্ছে।
কিডনির বিভিন্ন কাজের জন্য জীবন্ত কোষের দরকার। কালচার করে করে সে টিউব ও কোষ তৈরি করছে। একটি সিলিকনের টিউবের মধ্যে তাঁরা প্রতিস্থাপন করে দিচ্ছেন। কৃত্রিমভাবে কালচার করে প্রতিস্থাপন করে টিউব তৈরি করা হচ্ছে। টিউবওয়েলের ওপর একটি কৃত্রিম কাভার তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে যেন আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একে স্পর্শ না করতে পারে। এ বছর শূকরের ওপর এই পরীক্ষা করা হয়েছে। তার ফলাফল আমরা পেয়েছি সাত নভেম্বর। ওয়াশিংটনের সেই কনফারেন্সে আমি ছিলাম। শুভ রায়ও ছিলেন। তাঁর দলের একজন নারী সদস্য এটি উপস্থাপন করেন।
এখন মানুষের দেহে এটি প্রতিস্থাপন করতে হবে। স্বাভাবিক কিডনির আকারে এটি তৈরি করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, স্বাভাবিক কিডনির মতো এটি কাজ করবে। তবে কোনো মানুষের ওপর এ পরীক্ষা করা হয়নি। যুষ্টরাষ্ট্রের এফডিএ আশা করছে দ্রুতই এর সম্মতি দেবে। এরপর মানুষের ওপর পরীক্ষা হবে। প্রাথমিকভাবে সফল হলে বড়ভাবে পরীক্ষা হবে। সফল হওয়ার পর হয়তো এটি সবার হাতের নাগালে আসবে। এ জন্য আমাদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। ১০ থেকে ১৫ বছর লাগতে পারে।
তবে রোগীদের জন্য সুখবর হলো, এর মধ্যে কৃত্রিম ডায়ালাইজার, যেটি আমরা বেল্টে বেঁধে ঘুরতে পারব, সেটি চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে পেয়ে যাব। কারো হতাশ হওয়ার প্রয়োজন নেই।