আপনার কি ডায়াবেটিস আছে? জানুন বিস্তারিত
সারা বিশ্বে আজ পালিত হচ্ছে ডায়াবেটিস দিবস। দিবসটিকে ঘিরে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৬০৬তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. তাহসীন মাহমুদ।
ডা. তাহসীন মাহমুদ বর্তমানে বিআরবি হসপিটালে অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের পরামর্শক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : এবার বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় কী?
উত্তর : মূলত ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন ও ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন, ১৯৯১ সাল থেকে ডায়াবেটিস সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের প্রচলন করে। এটি প্রতি বছর ১৪ নভেম্বর পালিত হয়ে আসছে। তো অন্যান্য বছরের মতো, প্রতি বছরই প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে। এবারের প্রতিপাদ্য হলো—‘ডায়াবেটিস থেকে পরিবারের সদস্যদের রক্ষা করুন।’
যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো সচেতনতা। আসলে ডায়াবেটিস শব্দটা ছোট। তবে এর যে ভয়াবহতা এটি অনুধাবন করতে পারে না অনেকে। এর যে গুরুত্ব, সেটি চিন্তা করে, এই দিনকে সামনে আনা হচ্ছে। ইনসুলিনের আবিষ্কারক, স্যার ফ্রেডরিখ বেনটিনের জন্মদিনের দিন দিবসটি পালিত হয়। তিনি ১৪ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। এ উপলক্ষে এ দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। ডায়াবেটিসের বিষয়ে সচেতন করে তোলার জন্যই এ দিবস। দিবসটিকে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দিয়েছে ২০০৬ সালে।
প্রশ্ন : আমি তো সচেতন হব, পরিবারের মানুষের প্রতি সচেতন হতে হবে। সেটি আসলে কেন?
উত্তর : সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ৭২৫ মিলিয়নের ওপর মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। শুধু ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়ে এখন একটি দেশ গঠন করা যাবে!
অন্যভাবে বলি, এই ঘরের মধ্যে যদি ১১ জন মানুষকে আনা হয়, এর মধ্যে একজনকে ডায়াবেটিসের রোগী হিসেবে খুঁজে পাওয়া যাবে। যার ডায়াবেটিস থাকে তার কিডনি রোগের ঝুঁকি থাকে। ডায়ালাইসিস নেওয়ার মতো হয়ে যায় তিনি।
বিশ্বে নারী মৃত্যুর নবম প্রধান কারণ হলো, ডায়াবেটিস। প্রতি আট সেকেন্ডে একজন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে ডায়াবেটিসের কারণে। আমাদের দেশে বর্তমানে সাত মিলিয়নের বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
প্রশ্ন : এদিকে যেন যেতে না হয়, এর জন্য কী করণীয়?
উত্তর : ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে হলে, আগে বিষয়টিকে বুঝতে হবে। ডায়াবেটিস কী, সেটি বুঝতে হবে। এটি নিয়ে অনেক ভুল ধারণাও রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, এটি চিনির সমস্যা। রক্তে চিনি বেড়ে গেছে। আসলে ব্যাপারটা শুধু এটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ডায়াবেটিস অনেক কারণেই হতে পারে। তবে প্রধাণত দুটো কারণে এটি হয়। একটি হলো, ইনসুলিনের অভাব। দুই ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমে গেছে।
ইনসুলিন আসলে কী? ইনসুলিন হলো একটি হরমোন। এটি সম্পর্কে অনেকেই জানে না। আমরা গ্রোথ হরমোন সম্পর্কে জানি, স্টেরয়েড হরমোন সম্পর্কে জানি। তবে ইনসুলিন যে একটি হরমোন এ বিষয়টি অনেকে জানে না। ইনসুলিন আমাদের অগ্নাশয় থেকে তৈরি হয়। অগ্নাশয়ের মধ্যে কিছু কোষ ছড়িয়ে থাকে। এখান থাকে একটি নির্দিষ্ট প্রকৃতির কোষ, সেটি হলো, বিটা কোষ। এটি থেকেই ইনসুলিন বের হয়। সাধারণত দেখা যায়, ৫০ শতাংশ যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখন প্রি ডায়াবেটিস কোষ বৃদ্ধি পায়। আর ৮০ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেলে প্রি ডায়াবেটিসের পরবর্তী ধাপ, ডায়াবেটিস চলে আসে। এটা আসলে কেন হয়? জন্মগতভাবে হতে পারে, অটো ইমিউন ডিজিজের কারণে হতে পারে। তবে সবচেয়ে প্রচলিত যেটি, ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা যেভাবে হওয়া উচিত, সেটা করতে পারে না।
ইনুসলিন কাজ শুধু যে চিনিকে কোষের ভেতর ঢুকাবে তা নয়। এটি একই সঙ্গে চর্বির জন্যও কাজ করে, প্রোটিনের জন্য কাজ করে। আমাদের পুষ্টির প্রধান তিনটি উপাদান। কার্বোহাইড্রেট, লিপিড ও প্রোটিন। এখন ইনসুলিনের যদি কার্যক্ষমতা ঠিকমতো না থাকে, তাহলে সে একদিকে কার্বোহাইড্রেট ঢোকাতে পারছে না। রক্তনালি পা থেকে মাথা পর্যন্ত সব জায়গাতেই রয়েছে। আর যেখানে চিনি সেখানেই পিঁপড়া আসবে। এখানে তো আর পিঁপড়া আসার সুযোগ নেই। হয় যেটি, সেটি হলো অক্সিডেটিভ স্ট্রেস। এটি হলে ছোট ছোট রক্তনালিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শেষ পর্যন্ত চাপ পড়ে অঙ্গের ওপর। যেমন, মস্তিষ্ক যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, স্ট্রোক হয়। হার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হলে হার্ট অ্যাটাক হয়। কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হলে রেনাল ফেইলিউর হয়। এই গেল কার্বোহাইড্রেটের বিষয়।
লিপিডের কেজি অনেক বেড়ে যায়। একটি পাইপের মধ্যে যদি অনেক দিন ধরে পানি যেতে থাকে, আস্তে আস্তে শিসা জমতে থাকে, ব্লক হতে থাকে। সেরকম খারাপ কোলেস্টেরলগুলো বাড়তে থাকলে হার্টের নালিগুলো সরু হতে থাকে। সরু হতে হতে এক সময় ব্লক হয়ে যায়।
ইনসুলিন প্রোটিন তৈরি করতে সাহায্য করে। পেশি তৈরিতে সহযোগিতা করে। এই জিনিসটির অভাব হচ্ছে। কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে প্রোটিন ইউরিয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন করনারি হার্ট ডিজিজ জড়িত।
আসলে এটি কেবল চিনির রোগ নয়, আমরা যা খাই, তারই একটি মেটাবলিক ডিজঅর্ডার।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কী কী পরামর্শ আপনারা দিয়ে থাকেন?
উত্তর : এবার বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসে প্রতিরোধকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিস প্রতিরোধে কী করা জরুরি?
উত্তর : একজন মানুষ যখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়, এটি কেবল তার নয়, তার পরিবারকেও আক্রান্ত করে। এটি মানসিকভাবে হোক বা অর্থনৈতিকভাবে হোক। এখন আপনি যদি অর্থনীতির কথা চিন্তা করেন, ৭২৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার খরচ হয়েছে, ২০১৭ সালে কেবল ডায়াবেটিস ও এর জটিলতা ব্যবস্থাপনার জন্য। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের অর্থনীতির চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে শেষ ডাটা অনুযায়ী, প্রায় ৩৬৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, এই খাতে খরচ হয়ে গেছে। কেন এই খরচটা করবেন?
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে আপনি যদি কেবল জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন করেন, তাহলে ৪৩ থেকে ৫৮ শতাংশ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি আপনি নিজের হাতেই ৫০ ভাগ কমাতে পারবেন।
মানুষ আসলে অভ্যাসের দাস। আপনি চাইলেই আপনার নিজের যে জীবনযাপনের ধরন এত বছর ধরে পালন করে আসছেন, সেটি পারবেন না পরিবর্তন করতে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মেডিটারিয়ান ডায়েট ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। আমি চাইলে এখানে মেডিটেরিয়ান ডায়েট আনতে পারব না। আপামর জনসাধারণের জন্য এটি উপযোগী হবে না। আমাদের পারিপার্শ্বিকতার প্রেক্ষিতে একটি মডেল ব্যবহার করতে হবে।
ডায়েট কী? ড. মাউজি, জিম্বাবুয়ের একজন ডাক্তার, উনি এটি বের করেছেন। হ্যান্ড জাই মডেল। এটা হলো, আপনি যখন প্রার্থনার ভঙ্গি করেন, এতে দুই তালুর মধ্যে যা জায়গা হয়, এটি হওয়া উচিত আপনার সবজির পরিমাণ। আপনি যখন একটি হাত ধরেন, ছোট তালুর মধ্যে যা হবে, সেটি হলো, আপনার আমিষের পরিমাণ। মুঠিবদ্ধ হলে যে জায়গাটুকু হয়, সেটি হলো, আপনার ভাতের পরিমাণ। আমরা তিন বেলা প্রধান খাবার রাখব। এর সঙ্গে মধ্য সকালের নাস্তা, মধ্য বিকেলের নাস্তা, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে কিছু খেয়ে নেওয়া।
ওজন অন্তত সাত ভাগ কমিয়ে আনতে হবে। এটিও গবেষণা করে পাওয়া গেছে। ব্যায়াম করতে হবে। ব্যায়ামের সময় একজনকে সঙ্গে রাখবেন। তাহলে প্রেরণা পাবেন।