স্বপ্নের ফেরিওয়ালা
মৌসুমীর নাচ ও ফাতেমার গল্প
স্বপ্নপুরীর মানুষদের জীবনের খণ্ড গল্প নিয়ে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। এই জগতকে নিয়ে মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করলে আর জীবনে কখনো তাদের স্বপ্ন ভাঙে না। স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্ন সফলের স্বপ্নে সারাজীবন কেটে যায়। তবু এ জগত থেকে তাদের মুক্তি নেই। যারা স্বপ্ন সফলের সিঁড়ি পায় আজ তাদের কথা নয়। যারা স্বাপ্নিক মানুষের খপ্পরে পড়ে স্বাপ্নিক মানুষকে তুষ্ট করে নিজের স্বপ্ন সফলের জন্য সারাজীবন আশায় বুক বাঁধে তাদের গল্প হবে আজ।
সন তারিখ উল্লেখের প্রয়োজন নেই। এফডিসির ২নং ফ্লোর। একটি বাইজিপাড়ার সেট। সেট নির্মাণে যথাযথ চেষ্টা করা হয়েছে বাস্তবতার কাছাকাছি থাকার। ভেতরে ঢুকে গেলে সত্যি ঘোর তৈরি হয় বাইজিপাড়া বলে। পরিকল্পনার সব সুটিং শেষ। শুধু বাকি আছে মৌসুমীর অংশগুলো। সবাই অপেক্ষায় আছি, নায়িকা আসবে, তারপর বাকি কাজ শেষ হবে। তখন সেটে শিল্পী উপস্থিত আছেন- তারিক আনাম, সাদেক বাচ্চু, তুষার খান, ওমর সানিসহ পতিতার চরিত্রে অভিনয়ের ১০০ জন সহশিল্পী। সবাই অপেক্ষা করছে নায়িকা মৌসুমীর জন্য। অপেক্ষায় আছেন পরিচালক, ক্যামেরাম্যান, ফাইট ডিরেক্টর এবং নৃত্য পরিচালক। নৃত্য পরিচালকের দুজন সহকারী নৃত্য পরিচালক। একজন ছেলে, একজন মেয়ে। সহকারী নৃত্য পরিচালক মেয়েটি দুপুরের পর থেকে কেমন যেন অন্যমনস্ক অস্থির। সেটা মৌসুমী শুটিংয়ে কখন আসবে শুটিং কখন শুরু হবে সে জন্য নয়। যেন অন্য কিছু। রাত যখন সাড়ে ১০টা বাজে তখন পরিচালকের পক্ষ থেকে ঘোষণা এলো মৌসুমীর জন্য প্রয়োজনে সারারাত শুটিং হবে, তারপরও শুটিং শেষ করতে হবে। অনেকেই প্রথমে আপত্তি করলেও শেষে মেনে নিতে বাধ্য হয়, কারণ পরিচালকের নির্দেশ অপরিবর্তিত। শুধু সহকারী নৃত্য পরিচালক মেয়েটি যার নাম ফাতেমা (ছদ্ম নাম) সে মেনে নিতে পারেনি, ভেঙ্গে পড়ল প্রচণ্ড। উপায় অন্তর না দেখে সহকারী পরিচালক সামছুর কাছে সে একটা অনুরোধ জানাল- নৃত্য পরিচালক আমির হোসেন বাবুর কাছ থেকে যেন তাকে ছুটি নিয়ে দেয়। সামছু বলল- তুমি গিয়ে বলো।
আমি বলতে পারব না। আমার সমস্যা আছে।
কী সমস্যা?
আমি বললে তিনি সমস্যা জানতে চাইবেন। আমি তাঁকে সমস্যা নিজের মুখে বলতে পারব না। আর এটা এমন একটা সমস্যা যে সত্য কথা বলা যাবে না। বললে কেউ তাতে সমর্থন দিবে না।
কিন্তু আমাকে তো তোমার সত্য কথাটা বলতে হবে। নইলে আমি আবার কী বলতে কী বলে ফেলি।
কিছুক্ষণ ইতস্তত করে ফাতেমা বলল- আজ রাত ১২টায় একজনের সাথে আমার বিয়ে হবে। সব ঠিকঠাক। এখন শুধু আমি বাসায় যাব, গোসল করব, কাপড় পরব। তারপর বেরিয়ে বিয়ে করে রাতেই কক্সবাজার এক সপ্তাহের জন্য হানিমুন।
তুমি যদি এখন বের হও তাহলে কি তুমি এত কম সময়ে সব কাজ করতে পারবে?
সে জন্যই তো তাড়াহুড়া করছি। ১১টায় লোকটা আমার জন্য গাড়ি পাঠাবে।
শুটিংয়ের যে জটিল অবস্থা তাতে বাবু ভাই কোনো অবস্থাতেই তোমাকে যেতে দেবে না। মিথ্যা কথা বললেও না, সত্য বললে তো না-ই। কারণ এত রাতে তুমি একা একা কাকে বিয়ে করতে যাচ্ছ তা সে ভালোভাবে দেখতে চাইবে।
তুমি কাউকে কিছু না বলেই চলে যাও না। তুমি মেয়ে মানুষ কত রকম অসুস্থতার অজুহাত তুমি দেখাতে পারবে।
নারে ভাই, না বলে যেতে পারব না। কারণ না বলে গেলে তো সারাদিন পরিশ্রমের টাকাটা পাব না। এমন একটা দিনে কেউ এই কাজ করে? টাকার জন্যই তো করলাম। সে জানে আমি সিনেমার অভিনেত্রী। ফকিরের মতো খালি হাতে যাব নাকি। সে অনেক টাকার মালিক। আমার টাকা ধরেও দেখবে না। কিন্তু কিছু টাকা হাতে থাকলে সাহস পাই। মোটকথা আমার টাকাও লাগবে, যেতেও হবে।
সামছু মানবিক দিকটা বিবেচনা করে একটা রিস্ক নিল। সে ফাতেমাকে বলল- তোমার কাউকে কিছু বলতে হবে না। তোমার পাওনা টাকা আমি নিয়ে দিচ্ছি। তুমি তোমার ব্যাগ গোছাও।
কোনো বিপদ হবে নাতো।
কিচ্ছু হবে না যাও, তুমি তোমার ব্যাগ গোছাও।
ফাতেমা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সে ড্রেসিং রুমের দিকে চলে গেল। আর সামছু প্রোডাকশন ম্যানেজারকে খুঁজে বের করে সরাসরি বলল- ফতেমার বিল আজ পর্যন্ত কত হইছে ? ম্যানেজার পরিমাণ বলল। সামছু বলল- টাকাটা আমার কাছে দিন।
কেন?
দরকার আছে দেন ভাই। ও আপনার কাছে না চাইলেই তো হয়।
দেখেন আমি যাতে কোনো ক্যাঁচক্যাঁচের মধ্যে না পড়ি।
সামছু টাকাটা ফাতেমার হাতে দেওয়ার পর ফাতেমা শুধু বলল- এ কথা কোনো দিন ভুলুম না ভাই। বলে দৌড়ে হারিয়ে গেল। সামছু ফ্লোরের ভেতর গিয়ে দেখে সবাই রাতের খাবার খাচ্ছে। সেও সবার সাথে বসে খেল। ফাতেমার কথা এখন আর তার মনেই নেই। গরিব মানুষ বিয়ে করে সুখী হোক। কী দরকার এসব চলচ্চিত্রের কাজের। বাবু ভাই যদি ফাতেমাকে খোঁজে তখন বলবে ওর ব্লিডিং হচ্ছে তাই তাড়াতাড়ি তাকে বলে চলে গেছে। সবাই হয়তো একটু হাসাহাসি করবে। তাতে কিছু যায় আসে না।
মৌসুমী তখনো আসেনি। সবার খাবার শেষ হলে পরিচালক সামছুকে দায়িত্ব দেয় সব মেয়েকে নিয়ে এক জায়গায় বসে থাকতে। কোনো মেয়ে যেন এদিক সেদিক না যায়। সামছু সব মেয়েকে এক জায়গায় বসিয়ে জোকস্ বলতে লাগিয়ে দেয়। মেয়েদের প্রচণ্ড জোরে হাসাহাসি চলছে। এমন সময় সামছু দেখতে পায় ফাতেমা ক্লান্ত পায়ে ধীরে ধীরে হেঁটে ফিরে আসছে। বিস্মিত সামছু এগিয়ে যায় তার দিকে। জিজ্ঞেস করে কী ফিরে আসলে যে? সে নিস্তেজভাবে বলল- আমার যেতে একটু দেরী হয়। কিন্তু সন্ধ্যা থেকেই নাকি ঝর্ণা ওর পিছে লাগছে। এর মধ্যেই হারামজাদি ওরে ভাও কইরা আমার বদলে ওই গেছে।
লোকটা ঝর্ণাকে এর মধ্যেই ভালোবেসে ফেলল?
ওগো মাংসের টুকরা হইলেই চলে। ঝর্ণা কী আর ফাতেমাই কী।
অবশেষে মৌসুমী এলো সাড়ে ১২টার দিকে। পূর্ণোদ্যমে শুটিং চলছে। গানের শুটিং। রংবেরঙের আলো দেখে কারো বোঝার উপায় নেই একটু আগে ফাতেমার ওপর কী ঝড় বয়ে গেছে। ফাতেমাও যেন সব ভুলে গিয়ে কাজে মগ্ন। ক্লান্তিহীন ভাবে মৌসুমীকে নাচের মুদ্রা দেখাচ্ছে।
(চলবে)